অবৈধ সিগারেটে বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক :  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিবছর যে রাজস্ব আহরণ করছে, তার প্রায় আট ভাগের এক ভাগ আসছে সিগারেট কোম্পানির কর থেকে। প্রতিবছর এ খাত থেকে রাজস্ব বাড়ছে। অন্যদিকে এ খাতে রাজস্ব ফাঁকির ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। অবৈধ কারখানায় সিগারেট তৈরি, নকল ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার, একই ট্যাক্স স্ট্যাম্প বারবার ব্যবহার এবং চোরাই পথে বিদেশি সিগারেট আমদানি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে এবং সিগারেট কোম্পানি ও রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে মান অনুযায়ী সিগারেটকে চার স্তরে ভাগ করে ৭১ থেকে ৮১ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ করা হয়েছে। সবচেয়ে নিম্নস্তরে যে হারে কর আরোপ করা হয়েছে, তাতে ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম দাঁড়ায় ৩৭ টাকা। এই ৩৭ টাকা থেকে সরকারের রাজস্ব ২৬ টাকা ২৭ পয়সা। নিয়ম অনুযায়ী সরকারকে এই রাজস্ব পরিশোধ করেই কোম্পানিগুলোর বাজারে সিগারেট বিক্রি করার কথা। ফলে নির্ধারিত দামের কমে বিক্রির সুযোগ নেই সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কম দামে অনেক কোম্পানির নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, খুলনা, যশোর, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় কোনো কোনো কোম্পানি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিম্নস্তরের সিগারেট বেচাকেনা করছে। এসব কোম্পানি প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেট বিক্রি করছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে গোপনে বাজারে ছাড়া অবৈধ সিগারেটই রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া চোরাই পথে বিদেশ থেকে আনা কিছু উঁচু স্তরের সিগারেটও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে বেচাকেনা হচ্ছে। উঁচু স্তরের সিগারেটে করহার বেশি। ফলে এতে সরকারের রাজস্বের ক্ষতিও বেশি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই ফাঁকির বিষয়ে অবগত। এ জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাজার ও স্থানে অভিযান চালায় কাস্টমস এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিস। এনবিআরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন কাস্টমস হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেটের আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার শলাকা বা ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ প্যাকেট (প্রতিটি ১০ শলাকার প্যাকেট) সিগারেট আটক করা হয়। এসব সিগারেটের মোট মূল্য ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। ওই অর্থবছরে সিগারেট থেকে ২১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে। ভ্যাট কর্তৃপক্ষের অভিযানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা নকল সিগারেট কারখানা ও চোরাই পথে আনা সিগারেট ধরা পড়েছে। গত বছর ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কর্তৃপক্ষ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে অভিযান চালিয়ে রাইচ মিলের আড়ালে অবৈধ সিগারেট কারখানার সন্ধান পায়। অবৈধ এ কারখানায় উঁচু স্তরের সিগারেট নকল করে তৈরি করা হচ্ছিল। তবে অবৈধ সিগারেটের সামান্য অংশই অভিযানে ধরা পড়ছে। সিংহভাগই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।

এ বিষয়ে ঢাকা পশ্চিমের ভ্যাট কমিশনার ড. মইনুল খান বলেন, সিগারেট নিয়ে দেশে বড় ধরনের জালিয়াত চক্র গড়ে উঠেছে। চোরাই পথে আমদানি ও ট্যাক্স স্ট্যাম্প ছাড়া বাজারজাত করাসহ বিভিন্ন উপায়ে সিগারেটে রাজস্ব ফাঁকি হয়ে থাকে। একশ্রেণির লোক অনুমোদনহীন কারখানা স্থাপন করে প্রচলিত সিগারেট হুবহু নকল করে বাজারে ছাড়ছে। গত বছর টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে চালকলের আড়ালে এ রকম একটি কারখানা পাওয়া যায়, যা বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে মামলা করা হবে। আবার একটি শ্রেণি মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বা চোরাই পথে বিদেশ থেকে সিগারেট নিয়ে আসছে। অন্যদিকে কিছু অবৈধ কোম্পানি কোনো ধরনের রাজস্ব না দিয়েই বেচাকেনা করছে। কিছু নিবন্ধিত কোম্পানিও কৌশলে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। ফলে সরকার সিগারেট খাত থেকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। এই ফাঁকি কমানো গেলে সরকারের রাজস্ব যেমন বাড়বে, তেমনি সরকারের ধূমপান কমানোর লক্ষ্যও সহজে অর্জন হবে। এ জন্য রাজস্ব খাতের বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগ ও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উদ্যোগ দরকার।

এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সিগারেট বাজারজাত করছে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ জরিপ থাকলেও বাংলাদেশে কোনো জরিপ হয়নি। এনবিআর ধারণা করে, সারাবছর যত সিগারেট বাজারে বেচাকেনা হয়, তার তিন থেকে পাঁচ শতাংশ রাজস্বের বাইরে থেকে যায়। অনেকে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে গোপনে উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারজাত করে। আবার অনেকে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল নকল করছে বা একই স্ট্যাম্প বারবার ব্যবহার করছে। স্ট্যাম্প ছাড়াও অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া চোরাই পথে বিদেশ থেকে আমদানি করা সিগারেট বিক্রির কারণেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এনবিআর সামর্থ্য অনুযায়ী এসব ফাঁকি বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র শেখ শাবাব আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, সিগারেটের খুচরা মূল্যে গড়ে ৭৭ শতাংশ কর রয়েছে। কর না দিয়ে ১০০ টাকার সিগারেট বিক্রি করতে পারলে ৭৭ টাকা লাভ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ ধরনের ফাঁকির কারণে সরকার আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী নকল ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার করে অবৈধভাবে সিগারেট বাজারে ছাড়ছে। আবার কেউ কেউ কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। আবার যারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, তারা সিগারেটে অতি নিম্নমানের তামাক ও কাগজ ব্যবহার করছে। এসব অনুমোদনহীন কারখানার শ্রম ও পরিবেশ আইনের কোনোটাই মানা হচ্ছে না। তিনি বলেন, রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া, উগ্রবাদী বা জঙ্গি কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অপকর্মে ব্যবহার হওয়ার সুযোগ থেকে যায়, যা দেশের জন্য মারাত্মক সমস্যার কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

এনবিআরের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ সিগারেট বাজারে সরবরাহ করেছে, পরের অর্থবছরে তার চেয়ে ৯৯৯ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা কম সরবরাহ করেছে। সরবরাহ কম হওয়ার কারণে দুই হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা রাজস্ব কম পেয়েছে এনবিআর। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে বাজারে সিগারেটের সরবরাহ কমেনি। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বাজারজাত করায় এনবিআরের হিসাবে সব সিগারেট সরবরাহের তথ্য আসছে না।

বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন সিগারেটের স্ট্যাম্প ও ব্যান্ড মুদ্রণ করে থাকে। সংস্থাটির ২৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় সিগারেটের স্ট্যাম্প ও ব্যান্ড মুদ্রণ কমেছে। কিন্তু সিগারেটের বিক্রি বা ধূমপান এই হারে কমেনি। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সরকার ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে প্রতিবছর সিগারেটের ওপর কর বাড়াচ্ছে। যাতে জটিল রোগব্যাধি সৃষ্টিকারী এই পণ্যের দাম বাড়ে এবং ব্যবহার কমে আসে। কিন্তু রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে সিগারেট বাজারজাত করায় সরকারের এ উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৯ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে। দেশের মোট পুরুষ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক ধূমপান করে। আর নারী জনগোষ্ঠীর দেড় থেকে দুই শতাংশ ধূমপান করছে। প্রতিবছর সিগারেট কেনাবেচায় জিডিপির এক শতাংশ ব্যয় হয়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে সিগারেট হচ্ছে সবচেয়ে বড় উৎস। মোট ভ্যাটের ২৯ শতাংশ আসে সিগারেট থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার। পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।

Share