ঋণখেলাপিদের মাফ করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে : সংসদে অর্থমন্ত্র

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে নীতিমালা শিথিল করার কথাও উঠেছে। এবার খেলাপিদের মাফ করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করছে সরকার। গতকাল জাতীয় সংসদ অধিবেশনে এমন তথ্যই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এক বছর ধরে দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট চলছে। সংকট থেকে উত্তরণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরও পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। টানা দরপতন চলছে অর্থসংস্থানের বিকল্প উৎস পুঁজিবাজারেও। এ অবস্থায় নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার নিয়ে গতকাল জাতীয় সংসদে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।

খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চালানো যাবে না। আবার সবাইকে মাফও করা যাবে না। ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে সরকার।

সংসদে পৃথক প্রশ্নের উত্তরে দেশের পুঁজিবাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক বলেও স্বীকার করেন তিনি। আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা রাখার কথাও জানান।

গতকাল বিকালে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনের শুরুতে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে যারা খেলাপি হয়ে যায়, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অ্যাকশন অবশ্যই নিতে হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুদহার কমানো না গেলে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না। ঋণের সুদহার কমাতে পারলেই আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো বেঁচে যাবে। আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

তিনি বলেন, আমি সবার স্বার্থে এ কাজটি করতে চাচ্ছি। এরই মধ্যে অনেক বিতর্ক হচ্ছে, অনেকে অনেক রকম কথা বলছে। আমরা মাফ করে দিচ্ছি। মাফ কিন্তু সারা বিশ্বে করা হয়। সারা বিশ্বেই ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে কিন্তু মাফ করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কার্যকর ছিল না। এ কারণে ব্যাংকে ঢুকলে সেখান থেকে বের হওয়ার পথ ছিল না। তাই আমরা আইনগুলো কার্যকর করে সেই আইনি প্রক্রিয়ায় সহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করে সবাইকে এখান থেকে মাফ করার ব্যবস্থা করব।

ফারমার্স ব্যাংক প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক দেউলিয়া হোক, সরকার তা চায় না। ফারমার্স ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে বলে যে এর উত্তরসূরি পদ্মা ব্যাংকও ব্যর্থ হবে তেমন নয়। যারা ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন, তারা অবশ্যই সে টাকা ফেরত পাবেন।

সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, সুদহার এ মুহূর্তে সবার দুশ্চিন্তার জায়গা। প্রধানমন্ত্রী সুদহার নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী ব্যাংকঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনা হবে। এ বছরই এর সুফল দেখা যাবে। তাছাড়া সরল সুদের ওপর কম্পাউন্ড সুদ নেয়া যাবে না। আগামী ১ জুলাই থেকে এটা কার্যকর করা হবে।

সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেকের ধারণায় নাজুক অবস্থায় আছে। এটা আমাদের স্বীকার করতে দোষ নেই। এর মধ্যেও আমাদের ব্যাংকিং খাত খারাপ করছে তা বলব না। খারাপ করলে বিশ্বের পাঁচটি মাথাপিছু প্রবৃদ্ধি অর্জনের দেশে পরিণত হতে পারতাম না। আমাদের সমকক্ষ দুটি দেশ—একটি চীন, অন্যটি ভারত। এই অর্জন ব্যাংককে বাদ দিয়ে হয় না। তার পরও বলব, আমাদের রেট অব ইন্টারেস্ট অনেক বেশি।

তিনি বলেন, এখানে যে পরিমাণ ইন্টারেস্ট ধরা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা কিন্তু ব্যাংকগুলো পায় না। কয়েক দিন পর পরই এগুলো অবলোপন করতে হয়। আমাদের এখানের মতো ১৪-১৫ শতাংশ সুদহার পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রধানমন্ত্রী যে সিঙ্গেল ডিজিটের কথা বলেছিলেন, সেটিই গ্রহণযোগ্য ছিল। কারণ সিঙ্গেল ডিজিটের উপরে হলে যিনি ঋণ নিয়েছেন, তিনিও শোধ দিতে পারবেন না। আর যারা দিয়েছেন, তারাও পাবেন না। কয়েক দিন পর রাইট অফ করতে হয়। এতে দিনের শেষে দেখা যাবে, ৯ শতাংশও পাচ্ছে না। আমরা এর ওপর কাজ করছি। শিগগিরই সারা বিশ্বের সঙ্গে সমন্বিত করে অত্যন্ত কম্পিটিটিভ রেট আমরা করব।

সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য আহসানুল হক টিটুর এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার প্রথম প্রতিফলন পুঁজিবাজারে দেখা যায়। আমাদের দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত চাঙ্গা। অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের এই এগিয়ে যাওয়া থমকে যাবে, যদি শেয়ারবাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি। শেয়ারবাজারটি এখন নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটাও বলব না। বাজারে যেসব সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত করেছি। একে একে সব সমস্যার সমাধান দেব।

শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিয়ে সভা করার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, আরো মিটিং করব। মিটিং করে আর দশটি দেশে শেয়ারবাজার যেভাবে চলে, আমরাও সেইভাবে চালানোর চেষ্টা করব।

তিনি বলেন, সংগত কারণেই শেয়ারবাজারের জন্য আগামী বাজেটে প্রণোদনা থাকবে। তবে কতটা থাকবে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।

বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমানের (সুনামগঞ্জ-৪) রিজার্ভ চুরিসংক্রান্ত আরেক সম্পূরক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ১০০ মিলিয়ন ডলারের মতো আমাদের (বাংলাদেশ ব্যাংক) হ্যাক হয়েছিল। এর মধ্যে ৩০ মিলিয়নের মতো আমরা ফেরত পেয়েছি। এখনো আমাদের ৬০ মিলিয়ন ডলারের উপরে পাওয়া বাকি রয়ে গেছে। এ বিষয়ে একটা মামলা করা হয়েছে। মামলাটি এখন চলমান রয়েছে। তাই এ বিষয়ে সংসদে কিছু বলা ঠিক হবে না।

আর কোনো বেসরকারি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নয়

সংসদ সদস্য নূর নবী চৌধুরী শাওনের এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশে বেসরকারি খাতে ৩১টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ৪৫টি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। আপাতত এ ধরনের নতুন কোনো কোম্পানি অনুমোদনের পরিকল্পনা সরকারের নেই।

শস্য বীমা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর আশঙ্কা

সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর শস্য বীমাসংক্রান্ত এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, শস্য বীমার ভালো-মন্দ দুটোই আছে। শস্য বীমা করলে দেশে মাঝেমধ্যে, আমি সবাইকে দোষ দেব না; মাঝেমধ্যে দেখতে পাই, অনেক সময় নিজের গুদামে নিজে আগুন লাগিয়ে বীমা দাবি করে। শস্য বীমা সারা দেশে দিলে ভয়টা হচ্ছে, কৃষকরা তখন বীমার টাকা পাওয়ার জন্য কষ্ট করে চাষাবাদ করবেন না। তখন আমদানি করে আমাদের ভাত খেতে হবে।

Share