এই সাঈদ খুন হওয়া সাঈদ কি না, তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : আবু সাঈদ নামের যে ছেলেটি গ্রেপ্তার হয়েছে, সে আদতে খুন হওয়া আবু সাঈদ কি না, তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–৫-এর বিচারক বেগম ছামসুন নাহার আজ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন। ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এই প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন আদালত।

মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে ১২ বছর বয়সী আবু সাঈদ নামের এক কিশোর রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে অপহৃত হয়। এই অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হাজারীবাগ থানায় মামলা করেন তার বাবা আজম। সেই মামলা তদন্ত করে পরের বছর ২০১৫ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চারজনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে (দণ্ডবিধি ৩০২ ধারায়) আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।

আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, কিশোর আবু সাঈদকে অপহরণ করার পর লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে সোনিয়া আক্তার, তাঁর ভাই আফজাল হোসেন, সাইফুল হোসেন ও শাহিন নামের চারজন জড়িত ছিলেন। কিশোর আবু সাঈদকে অপহরণ করে লঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন বলে আফজাল হোসেন ও সাইফুল ইসলাম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।

আদালত অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে সোনিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেন। এই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ মোট ৯ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। দুই দফায় মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিনও ঠিক করা হয়। এমন অবস্থায় গত ৩১ আগস্ট আবু সাঈদ রাজধানীর পল্লবী থেকে তার মা–বাবাসহ গ্রেপ্তার হয়। মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আবু সাঈদসহ চারজন কারাগারে আছে।

কথিত আবু সাঈদ হত্যা মামলার দুই আসামি সাইফুল ও আফজাল দাবি করেছেন, ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবির তৎকালীন এসআই রুহুল আমিন তাঁদের ওপর নির্যাতন করেন। সাইফুল বলেছেন, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এসআই রুহুল আমিন বলেছিলেন, সাঈদকে খুন করার কথা স্বীকার না করলে তাঁকে খুন করে ফেলা হবে। মৃত্যুভয়ে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন।

এই সাঈদ সেই সাঈদ কি না : গত রোববার কথিত আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামিদের আইনজীবী আদালতকে জানান, যে কিশোর আবু সাঈদ খুনের মামলা এই আদালতে চলছে, সেই আবু সাঈদ আদৌ খুন হয়নি। সেই আবু সাঈদকে আদালতে হাজির করার জন্য তিনি লিখিত আবেদন করেন। আদালত সেদিন আবু সাঈদকে হাজির করার জন্য নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে আজ আবু সাঈদ, তার বাবা ও মাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। কথিত আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি সোনিয়া আক্তার, আফজাল হোসেন ও সাইফুল ইসলাম আদালতে হাজির ছিলেন।

আদালত আবু সাঈদের কাছে জানতে চান, সে আদতে আবু সাঈদ কি না? জবাবে আবু সাঈদ আদালতকে বলে, সে–ই হলো আবু সাঈদ। পড়ালেখা করতে ভালো না লাগার কারণে ২০১৪ সালে সে হাজারীবাগ থেকে শ্রীপুরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে বাস-লেগুনার চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে। এরপর থেকে মা–বাবার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। গত ১৯ আগস্ট শ্রীপুর থেকে হাজারীবাগে আসে সে। পরে মা–বাবার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। আদালত তখন আবু সাঈদের কাছে জানতে চান, এত দিন কী মা–বাবার কথা মনে পড়েনি? আবু সাঈদ তখন চুপ ছিল।

আবু সাঈদের কথা শোনার পর তার বাবা আজমকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তোলা হয়। আদালত আজমের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। আদালতের কাছে আজম দাবি করেন, পাঁচ বছর আগে তাঁর ছেলে আবু সাঈদ হারিয়ে গেলে হাজারীবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর আবু সাঈদের খোঁজে এলাকায় তার ছবি দিয়ে পোস্টারও লাগানো হয়েছিল। তাতেও খোঁজ না পাওয়ার পর তিনি বাদী হয়ে হাজারীবাগ থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। তাঁর ছেলে আবু সাঈদ আজ এই আদালতে হাজির আছে।

এ সময় কথিত আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান আদালতকে বলেন, যে ছেলেটিকে খুন করা হয়েছিল বলে বিচার চলছে, সেই ছেলেটি আদালতে হাজির রয়েছে। পুলিশ নির্যাতন করে দুজন আসামিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিল। মিথ্যা খুনের মামলার আসামি হওয়ায় তাঁর মক্কেলরা জমি বিক্রি করেছেন। মিথ্যা খুনের মামলার আসামি হয়েছেন।

আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী আদালতকে বলেন, যে ছেলেটি আদৌ খুন হয়নি, অথচ পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়ে বলেছে ছেলেটি খুন হয়েছে। এ নিয়ে পত্রিকায় বিভিন্ন লেখা আসছে। আবু সাঈদের ফিরে আসা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান আদালতকে আরও বলেন, কথিত আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি সোনিয়া আক্তারের স্বামী মিরাজ হোসেন এসব ঘটনার নায়ক। মিরাজ হোসেনের আত্মীয় আবু সাঈদের বাবা আজম। এই অপহরণ ও খুনের ঘটনা সাজানোর মূলে আছেন মিরাজ হোসেন। পুলিশ সোনিয়াদের ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে।

Share