নুসরাত হত্যা নিয়ে শুরু থেকেই তাচ্ছিল্য ছিল সবার

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির যৌন নিপীড়ন ঘটনার ব্যাপারে প্রশাসন, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তুচ্ছ তাচ্ছিল্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটিও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর সবার টনক নড়ে।

এমনই তথ্য পেয়েছে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত দল।

তদন্ত টিম নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও পুলিশের দায়িত্বহীনতার বিষয়ে জানতে ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসসহ ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের এ তালিকায় রয়েছেন- নুসরাতকে যৌন হয়রানির পর তাকে আগুন দেওয়া এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে দায়িত্বে ছিলেন যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য। এছাড়া রয়েছেন মাদ্রাসা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক।

পুলিশ সদরদপ্তরের তদন্ত দলের প্রধান ডিআইজি এসএম রুহুল আমিন বলেন, আমরা সব কিছু গুছিয়ে এনেছি। নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশ, প্রশাসন ও মাদ্রাসা কমিটির কি নেগলেজেন্সি ছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কবে নাগাদ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবো। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের করণীয় সম্পর্কে তদন্ত টিম বেশ কিছু মতামত দেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি রুহুল আমিন কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, আমরা তদন্তে যা পেয়েছি, সেটাই প্রতিবেদন উল্লেখ করবো। তদন্তের ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, তদন্ত চলছে, তথ্য সংগ্রহের প্রাথমিক কাজ শেষ পর্যায়ে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রতিবেদনে কার কতটুকু দায় ছিল কিংবা আসলেই কারও দায় ছিল কি না- সে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সোহেল রানা আরো বলেন, প্রতিবেদনের যদি পুলিশের কোনো সদস্যের দায়িত্বে অবহেলা বা অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাদের অপরাধ ফৌজদারি সমতুল্য হলে প্রচলিত আইনে মামলা হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্ত দল ৩৫ থেকে ৩৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাইয়ের জন্য দ্বিতীয় দফায় আরো ১২/১৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও প্রতিবেদন দিতে আরও ৮-১০ দিন সময় লাগবে।

তদন্ত সূত্র জানায়, নুসরাত ছাড়াও আরো কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্রী অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল বলে পুলিশের তদন্ত কমিটির তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে। যৌন নিপীড়নের মামলায় কারাগারে গেলেও জেলে বসেই নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। তদন্ত কমিটির সদস্যরা মনে করছেন, মাদ্রাসার গভর্নিং বডি আগের বিষয়গুলো আমলে নিলে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা এড়ানো যেত। সূত্র জানায়, নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনকে প্রশাসন, পুলিশ, মাদ্রাসা কমিটি এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ কোন রকম গুরুত্ব দেয়নি। তারা বিষয়টি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হিসেবেই গণ্য করেছে। নুসরাতের শরীরের আগুন দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সবাই নড়ে চড়ে বসে।

পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত দলের প্রধান ডিআইজি এসএম রুহুল আমিন জানান, সিরাজ উদ দৌলা এর আগে আরও অনেক ছাত্রীর সঙ্গেই নুসরাতের মতোই ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে নুসরাতের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সঙ্গেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছিল ছ’মাস আগে। বিষয়টি মাদ্রাসা গভর্নিং বডিকে লিখিত আকারে জানিয়েছিলেন ভিকটিমের বাবা। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পারিনি। ওই অভিযোগগুলোর যদি সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তবে হয়তো নুসরাতের মৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনাটি না-ও ঘটতে পারত বলে মনে করেন তিনি।

গুরুত্ব দেননি পুলিশ সুপার তদন্ত সূত্র জানায়, যে দিন (৬ এপ্রিল) নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়া হয় বিষয়টি ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমকে জানানো পরও তিনি (পুলিশ) ঘটনাস্থলে আসেননি। ঘটনা শুনেও এসপি রওয়ানা হন খাগড়াছড়ির ক্রীড়া অনুষ্ঠানে। পরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির নির্দেশে পুলিশ সুপার ফেনীতে ফিরে আসেন।

সূত্র জানায়, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। মামলা দায়েরের পর নুসরাতের নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে পুলিশ উদ্দ্যোগ নেয়নি। এ ব্যাপারে তদন্ত টিমের কাছে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ৩০ তারিখ উপজেলা নির্বাচন ছিল। এ ব্যাপারে পুলিশ ব্যস্ত থাকার কারণে নাকি নুসরাতের নিরাপত্তার বিষয়টির দিকে নজর দিতে পারেননি।

অপরদিকে, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুরসাতের মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন। এমনকি হত্যা মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নামটি লিখেছিলেন সিরাজুল ইসলাম। শুধু তাই নয় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার পদ পদবি পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। শুধু সিরাজ উদদৌলার বাড়ির ঠিকানা লিখেছিলেন।

সূত্র জানায়, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধীনের রয়েছে ১২টি দোকান। প্রতিমাসে এসব দোকান থেকে ভাড়া আদায় হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। পাশাপাশি মাদ্রাসার ভেতরে পুকুরে মাছের চাষ করা হয়। সেখান থেকেও মোটা অংকের টাকা আসে। এছাড়া প্রতি মাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদানের পরিমাণ ছিল অনেক।

সূত্র আরো জানায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে রয়েছে দুইটি গ্রুপ। একটি গ্রুপ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেত। ওই গ্রুপটি ঘটনার পর অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে রক্ষায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

আর্থিক লেনদেন তথ্য পায়নি সিআইডি নুসরাত হত্যার ঘটনা চাপা দিতে ১৭ লাখ টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে। এমন তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর তদন্ত শুরু করে সিআইডি। সিআইডির তদন্ত টিমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম সোনাগাজীতে অবস্থিত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে অনুসন্ধান চালায়।

এ ব্যাপারে সিআইডি অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তারা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ মাদ্রাসার একাউন্টের পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হবে। তবে তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে বোরখাসহ অন্যান জিনিস কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম। একই তথ্য জানিয়েছেন একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা। ঘটনার পর ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির একটি টিম ঘঠনাস্থল পরিদর্শন করে।

উল্লেখ্য, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলা তদন্ত করছে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন )। এ মামলায় পুলিশ ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে।

Share