পদ্মা সেতু নির্মাণ এলাকায় ঢোকা–বের হওয়া নিষেধ

নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : বৈশাখের দমকা হাওয়ায় পদ্মা নদীতে এখন প্রচণ্ড ঢেউ। ঝড়-বৃষ্টি প্রায় প্রতিদিনই আঘাত করছে পদ্মার বুকে। নদীর পানিও তাই বাড়ছে তরতর করে। এর মধ্যে বড় বিপত্তি মহামারি করোনাভাইরাস। এর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের পাঁচ হাজার জনবলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে পদ্মা সেতু। সেতুর কাজে কর্মরতদের করোনা মহামারি থেকে রক্ষা করতে নেওয়া হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ।

পদ্মা সেতুর পিয়ার তৈরি করা ছাড়া পুরো সেতুটি তৈরি হচ্ছে চীনের উহান শহরে কারখানায়। স্টিলের বড় বড় খণ্ড তৈরি করে সমুদ্রপথে জাহাজে করে আনা হয় বাংলাদেশে। এরপর মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে জোড়া লাগিয়ে প্রস্তুত করা স্প্যান বসানো হয় পিয়ারের ওপর। আনুষঙ্গিক অন্যান্য সরঞ্জামের প্রায় সবটাই তৈরি হয় চীনে। তবে বাংলাদেশে এসব প্রস্তুত করে পদ্মা সেতু তৈরিতে যুক্ত রয়েছেন তিন হাজার শ্রমিক। এর সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক রয়েছেন নদীশাসনের কাজে। এই সাড়ে চার হাজার শ্রমিকের সবাই মূল সেতুর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও নদীশাসনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশনের অধীনে কাজ করেন। এ ছাড়া প্রকল্পের বিদেশি পরামর্শক রয়েছেন ১৫০ জন। আরও রয়েছেন সেতু কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত প্রকৌশলীসহ ২২ জন, নিরাপত্তার দায়িত্বের ১৪০ জন আনসার সদস্য। প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের বড় একটি অংশ চীনের নাগরিকসহ ২২টি দেশের নাগরিকও পদ্মা সেতুর প্রকল্পে কাজ করছেন। সব মিলিয়ে ৪ হাজার ৮১২ জন পদ্মা সেতুর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।

পুরো পদ্মা সেতু প্রকল্পের চীনা নাগরিকদের বড় একটি অংশ চীনা নববর্ষ উদযাপন করতে চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারি নিজ দেশে বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়েন। অবশ্য মূল সেতুর সঙ্গে যুক্ত চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের ৬৭ জন কর্মকর্তা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই নববর্ষ পালন না করেই ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তবে ১৯৮ জন চীনা দক্ষ শ্রমিক আটকা পড়েন নিজ দেশে। তাঁদের মধ্যে ২৬ জন ফেব্রুয়ারি মাসের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আসেন। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ফেরত আসা চায়নিজদের প্রকল্প এলাকায় কোয়ারেন্টিনে ১৪ দিন রাখা হয়। এ দেশে আসার আগে চীনেও তাঁরা ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। একই প্রক্রিয়ায় আরও ৪২ জন চায়নিজ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে এসেছেন। তবে তাঁদেরও কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। বাকি ১৩০ চীনা শ্রমিক একইভাবে বাংলাদেশে ফেরেন গত মার্চ মাসে। কোয়ারেন্টিন পর্ব শেষ করে তাঁরা সবাই প্রকল্পের কাজে ফিরে এসেছেন।

কোয়ারেন্টিনের মধ্যেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের জনবলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পর্বের ইতি টানা হয়নি। পুরো প্রকল্প এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাওয়া ও জাজিরায় দুই পাশের ১৩২ একর এবং দুই পাশের ৪০০ একর কনস্ট্রাকশন এলাকা। বহিরাগতদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সাড়ে চার হাজার শ্রমিককে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের ভেতরে আনা হয়েছে। তাঁদের সবার খাবার সরবরাহ করছেন ঠিকাদারেরা। আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে। প্রকল্পের দুই পাশেই হাসপাতাল রয়েছে। এর শয্যাসংখ্যা ১২। চিকিৎসাসেবায় চারজন চিকিৎসক ও চারজন নার্স রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে একজন সেফটি অ্যান্ড হেলথ স্পেশালিস্ট রয়েছেন। চার বছর ধরে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্তদের স্বাস্থ্যসেবা তাঁর পরামর্শে দেওয়া হয়। প্রকল্প এলাকার বাইরে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে থেকে বা ঢাকা থেকে সংশ্লিষ্ট কেউ এলে তাঁকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এর আগে তিনি কাজে যোগ দিতে পারবেন না।

খাবার সরবরাহের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি আছে। সেসব গাড়িতে আনা খাদ্যপণ্য প্রকল্পের গেটে রাখা হয়। জীবাণুমুক্ত করে এগুলো ভেতরে রাখা হয়। খাবার রান্না হয় প্রকল্প এলাকার ভেতরে। সেই রান্না পরে পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া বিদেশিদের জন্য আগে থেকে ক্যানটিন রয়েছে।

করোনা পরিস্থিতির তথ্য জানতে প্রকল্প এলাকার পাশে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও শ্রীনগর এবং শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখা হয়। এসব এলাকায় কেউ করোনা আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। সেই অনুযায়ী প্রকল্পের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম আইইডিসিআরের পরামর্শ ও নির্দেশনায় চালানো হচ্ছে। প্রকল্প এলাকার ভেতরে থাকা সবারই প্রতিদিন সকাল-বিকেল শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। কারও মধ্যে কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানো হয়। শ্রমিকদের মধ্যে কেউ বাইরে যেতে চাইলে তাঁকে একেবারে ছুটি দেওয়া হয়। নিয়ম মেনে চলায় এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার জনবলের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি।

পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরের লোক ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। শ্রমিকেরা কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে থাকছেন, খাবারও দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা যেন বাইরে না যান বা যেতে না হয়, সে জন্য ভেতরেই ক্যানটিন করে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এমনকি আমি নিজেও যদি প্রকল্প এলাকায় যাই, তাহলে আমাকে সেখানে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এরপর কাজ করতে হবে। এর কোনো ধরনের নড়চড় হবে না।’

নিয়মেই মিলছে সুফল : পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পানিতে থাকবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার অংশ। এই অংশ ৪১টি স্প্যান দিয়ে যুক্ত হবে। বাকি ৩ দশমিক ১৫ কিলোমিটার থাকবে ডাঙায়। এটি রড-কংক্রিট দিয়ে তৈরি হবে। অংশটি ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল সেতুর নির্মাণের কাজ শুরু করে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। করোনাভাইরাসে দুর্যোগের মধ্যেও ২০২১ সালের জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু সম্পন্নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ৪ মে পর্যন্ত নয়টি স্প্যান বসানো হয়েছে। মূল সেতুর ৪২টি পিয়ারের সবগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। ৫০০টি রোড ও ১০০০টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্য ২৫ ও ২৬ এবং ২৬ ও ২৭ নম্বর পিয়ারের ওপর আরও দুটি স্প্যান বসানো হবে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এখন মূল পদ্মা সেতুর মাত্র ১৩ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে বাকি কাজ কবে শেষ হবে। এ কথা জানিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে বর্তমানে স্বাভাবিকের ৭০ শতাংশ কাজ করা যাচ্ছে। বিদেশি প্রকৌশলীদের অনেকে নিজ দেশে রয়েছেন। বাকি কাজ কবে শেষ হবে, সেটি করোনা পরিস্থিতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে।

Share