ব্যাংকে সুদহার কমানোর কারণে এনজিওর ফাঁদে সঞ্চয়কারীরা

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ব্যাংক খাতে আমানতের সুদহার কমানোর পর থেকে বেশি সুদ পাওয়ার আশায় সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) দিকে ঝুঁকছেন। এতে তাঁদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, বেশি সুদের প্রলোভন দেখিয়ে অনুমোদনহীন অনেক প্রতিষ্ঠানও আমানত সংগ্রহ করতে শুরু করেছে।

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) অনুমোদন ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এমআরএ সম্প্রতি একাধিক অভিযোগ পেয়েছে। এ কারণে গত সপ্তাহে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করেছে এমআরএ কর্তৃপক্ষ। তাতে বলা হয়েছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমআরএর সনদ ছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠান বেশি হারে সুদ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয় সংগ্রহ করছে। এমআরএর সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের নামে অফিস খুলে স্থায়ী বা মেয়াদি আমানতও (ডিপিএস, এফডিআর) সংগ্রহ করছে কেউ কেউ, যা জনস্বার্থের পরিপন্থী।

বর্তমানে সারা দেশে অনুমোদিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৭০০। তবে অনুমোদনহীন কিছু প্রতিষ্ঠান আমানতের বিপরীতে উচ্চ হারে সুদের প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে, ঋণও দিচ্ছে উচ্চ সুদে। এতে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ রকম ১৭টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে উভয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রুরাল অ্যাসিসট্যান্স ফর পুওর এমপ্লয়মেন্ট (র‌্যাপ) ছাড়া বাকি ১৬টির ঠিকানাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। কয়েকটি আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশাপাশি রাজশাহী এবং অন্য জেলায়ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এমআরএর নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান অমলেন্দু মুখার্জী বলেন, ‘উচ্চ সুদের ফাঁদে পড়ে আগেও গরিব মানুষ অনেক প্রতারিত হয়েছে। আমরা এটা আর দেখতে চাই না। তাই যেখানেই আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ সনদবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।

ব্যাংক খাতে যেকোনো আমানতের সুদহার কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পর থেকে অনেকে উচ্চ সুদের লোভে এনজিওতে আমানত রাখছেন।

তবে ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এম এ বাকী খলীলী বলেন, ‘প্রত্যন্ত এলাকায় বেশি ঘটে এগুলো। তবে এই সমস্যা নতুন নয়। এখন হয়তো বেড়েছে। সরকারের উচিত হবে সব ধরনের প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করা।’

সমাজসেবার কথা বলে ক্ষুদ্রঋণ : রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভায় ডেভেলপমেন্ট অব এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক্যাল সোসাইটি (ডিস) নামক সংস্থাটি রাজশাহী সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে নিবন্ধন নেয় ২০১৩ সালে। সংস্থাটি রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমও পরিচালনা করে আসছিল। সম্প্রতি বেআইনিভাবে তাদের কার্যক্রম চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে।

এদিকে নিবন্ধন ছাড়া আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড করে আসছিল র‌্যাপ। এমআরএর একটি দল সরেজমিন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং র‌্যাপকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষায় এ ধরনের বেআইনি কার্যক্রম বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসককেও (ডিসি) আলাদা চিঠি দিয়ে এমআরএ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন, ‘এমআরএর চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

এমআরএ পরিচালকের স্বাক্ষর জাল : রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির ঠিকানা হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের আন্দিপুর। এমআরএর তদন্তে উঠে এসেছে রাজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি এমআরএর একজন পরিচালকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া সনদ তৈরি করেছে। আর এটি দেখিয়ে একটি শ্রেণি গরিব মানুষের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা নিচ্ছে, আবার উচ্চ সুদে ঋণও দিচ্ছে।

এমআরএ এই সংস্থাকেও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে বলেছে এবং এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি এ জেড এম নূরুল হক এমআরএ এবং এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোকে চিঠি দিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠানের বেআইনি কর্মকাণ্ডের
কথা জানিয়েছে।

তালিকায় আরও প্রতিষ্ঠান : চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে চিহ্নিত করেছে এমআরএ।

সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩৬টি শাখা থাকা সংস্থাটির নাম জেলার চারটি জায়গার নামে। সংস্থাটির নাম মধুমতি, বোয়ালিয়া, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।তদন্ত দল সরেজমিনে দেখেছে, এরসাইনবোর্ডে এমআরএর সনদ নম্বর উল্লেখ নেই।

এটিসহ জেলার গোমস্তাপুরে রয়েছে ১০টি সংস্থা। এগুলো হচ্ছে ইকোনমিক অ্যান্ড এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (ইডস), আদো পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, বাংলাদেশ আইডিয়াল ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (বাইডস), চেতনা পল্লী উন্নয়ন সংস্থা (সিপিইউএস), মহানন্দা ইমেন্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (মিডস), মহানন্দা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (মাইডস), সোনার বাংলা পল্লী উন্নয়ন সংস্থা, ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এবং ময়নামতি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড।

এ ছাড়া রয়েছে জেলার ভোলাহাটের বাংলাদেশ আইডিয়াল সোসাইটি ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন (বিসিফ), নাচোলের মানবিক সেবা সোসাইটি (এমএসএস), শিবগঞ্জের কুসুমকলি পল্লী উন্নয়ন সোসাইটি, মহিপুরের পল্লী সাহায্য সংস্থা (পিএসএস) এবং নাচোলের স্টার সোসাইটি (এসএস)।

Share