ভার্চ্যুয়াল আদালতের আইনজীবীদের প্রশিক্ষণে গুরুত্বারোপ

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সময়ে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর বিষয়টি বিচার বিভাগের ইতিহাসে অনেক বড় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আইনজীবী এবং আদালতের বিচারক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ দরকার।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘করোনাজনিত পরিস্থিতির কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ। মানুষের শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে কবে নাগাদ আদালত চালু হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতির মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে আমাদের মধ্যে হয়তো ২০ ভাগ মানুষ টেকনোলজির সঙ্গে পরিচিত। অনেক আইনজীবীর সম্পৃক্ত হতে সময় লাগতে পারে। একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকের অ্যানড্রয়েড ফোন নেই। অনেকে ঢাকার বাইরে আছেন, ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এই সমস্যাগুলো হবে।’

একই কথা বলেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আইনজীবীসহ বিচারপ্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ খুবই দরকার। কারণ, অনেক আইনজীবী তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নন।’

এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি জেনেছি, বিজ্ঞ বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমি আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনব। কোর্টের অন্যান্য কর্মচারীকেও প্রশিক্ষণের আওতায় আনব। আদালতের নথিগুলো ই-ফাইলিং করা হবে। কারণ হচ্ছে, সবাই মিলে যদি না করা হয়, এখানে যদি কোথাও একটা খুঁত থেকে যায়, তাহলে সাকসেসফুল (সাফল্য) হওয়া ডিফিকাল্ট (কঠিন) হবে।’

ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু করার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর বিষয়টি ভালো উদ্যোগ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়াল আদালত পরিচালিত হবে। এ জন্য আদালতের স্টাফদের ট্রেনিং লাগবে, ল–ইয়ারদের ট্রেনিং লাগবে, বিচারকদেরও ট্রেনিং লাগবে। যদি সেটা না হয়, তাহলে তো সমস্যা হবে।’

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর জন্য গত ২৬ মার্চ থেকে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ২৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় ভার্চ্যুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য আদালত কর্তৃক ‘তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’–এর খসড়া গত বুধবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অধ্যাদেশটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। আজ সোমবার থেকে স্বল্প পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু হচ্ছে।

ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর ব্যাপারে গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ভার্চ্যুয়াল আদালতকক্ষ ব্যবহারবিধি প্রকাশ করা হয়েছে। আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ অনুযায়ী জারি করা ‘বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ অনুসরণ করে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শুধু জামিন–সংক্রান্ত বিষয় নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।

ভবিষ্যতে বড় পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালত : সাক্ষ্য আইনে সংশোধনী আনা ছাড়া ভার্চ্যুয়ালি সাক্ষ্যগ্রহণ বা ট্রায়াল করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘বড় পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু করতে গেলে, অর্থাৎ, বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ করতে গেলে আমাদের যে সাক্ষ্য আইন আছে, তার কিছু সংশোধন করতে হবে। আর সাক্ষ্য আইনের সংশোধন করার জন্য যে ড্রাফট (খসড়া) দরকার, সেটা আমরা প্রস্তুত করেছি। আমি মনে করলাম, সাক্ষ্য আইন সংশোধন করতে গেলে, বড় পরিসরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করাটা ভালো। এ জন্য এই মুহূর্তে ওই কাজটি করা সম্ভব নয়। আমরা আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করব। বিচারিক কাজ বা সাক্ষ্য গ্রহণ আদালতগুলো ভার্চ্যুয়ালি করবে সাক্ষ্য আইনের সংশোধনীর পর। এখন স্বল্প পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালতের যে ছোট ছোট অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমরা ধরতে পারব। এখানে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে, আমরা ধরতে পারব। সেগুলো সব পূরণ করে বড় পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালত হবে।’

তবে স্থায়ীভাবে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ইতিমধ্যে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু রয়েছে। আমাদের দেশেও স্থায়ীভাবে এই আদালত চালু করা উচিত। ভারতের বেশ কিছু জায়গায় চালু হয়েছে। শুধু হাজিরা দেওয়ার জন্য আসামিদের হাজত থেকে আদালতে আনার কোনো অর্থ হয় না। এটা অমানবিক।’

এর আগে সাক্ষ্য ও বিচার কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আইনের খসড়া আইন প্রস্তুত করে আইন কমিশন। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এই আইনের খসড়াটি প্রকাশ করা হয়েছে। জমা দেওয়া হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছেও। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভার্চ্যুয়াল আদালত চালুর সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে নতুন যেকোনো জিনিস বাস্তবায়ন করতে গেলে সমস্যা আসতে পারে। সেগুলোর সমাধানও রয়েছে।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার এই সময়ে আদালত বন্ধ। তবে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু হওয়ার বিষয়টি খুশির খবর। কিন্তু আমাদের বহু আইনজীবী আধুনিক টেকনোলজির সঙ্গে পরিচিত নন। আদালতের অনেক কর্মচারীও অতটা পরিচিত নন। এসব লোককে যত দ্রুত সম্ভব প্রশিক্ষণ দেওয়াটা খুব জরুরি।’

ভার্চ্যুয়াল আদালত : ভার্চ্যুয়াল আদালতের ব্যবহারের ম্যানুয়াল অনুযায়ী, ভার্চ্যুয়াল আদালত পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের জন্য http://mycourt.judiciary.org.bd/users/login নামের একটি ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রবেশের পর নিজের মোবাইল নম্বর, ই–মেইল ও পূর্ণাঙ্গ নাম লিখে নিবন্ধন করতে হবে। এরপর নিবন্ধিত মোবাইল ফোন নম্বরে একটা খুদে বার্তা যাবে। পরে ওয়েবসাইটে ঢোকার পাসওয়ার্ড পাঠানো হবে মুঠোফোনে।

পরে ব্যবহারকারী http://mycourt.judiciary.org.bd/users/login এর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে পারবেন। জমা দিতে পারবেন জামিননামাও। এ ছাড়া ভার্চ্যুয়াল শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য ব্যবহারকারীর মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপে মাইক্রোসফট টিম নামের সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করে হবে। এই অ্যাপসটির মাধ্যমে ব্যবহারকারী ভার্চ্যুয়াল শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন।

কীভাবে ব্যবহারকারী ভার্চ্যুয়াল শুনানিতে অংশ নেবেন বা জামিননামা, বেইল বন্ড দাখিল করবেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছে http://muktopaath.gov.bd/course-details/249 ওয়েবসাইট। একই সঙ্গে যে কেউ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।

Share