মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গ্রাম মুছে ফেলে সরকারি ভবন, পুলিশ ব্যারাক নির্মাণ

নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে পুলিশ ব্যারাক, সরকারি ভবন ও শরণার্থীশিবির তৈরি করা হচ্ছে। মিয়ানমারে এক সরকারি সফরে গিয়ে বিবিসির সাংবাদিকের চোখে বিষয়টি ধরা পড়েছে।

আজ মঙ্গলবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, বিবিসি চারটি জায়গা দেখতে পেয়েছে, যেখানে স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, জায়গাগুলোতে আগে রোহিঙ্গাদের বাস ছিল। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাখাইন রাজ্যের ওই গ্রামগুলোতে ভবন নির্মাণের কথা অস্বীকার করেছে।

২০১৭ সালে সামরিক অভিযান ও ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার ছেড়ে পালায় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ এটাকে জাতিগত নিধন বলে উল্লেখ করেছে। তবে মিয়ানমার তাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপক পরিসরের এই হত্যাযজ্ঞের কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এখন দেশটি বলছে তারা কিছু শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে রাজি আছে। তবে গত মাসে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের দ্বিতীয়বারের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার অনুমোদিত ৩ হাজার ৪৫০ রোহিঙ্গা দলের কেউ দেশটিতে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপারে দায়বদ্ধতার অভাব, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও নাগরিকত্ব পাওয়ার অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরে তারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে মিয়ানমার বাংলাদেশকে দোষারোপ করেছে। তারা বলছে, ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের বড় প্রস্তুতি ছিল। এ কথার সত্যতা প্রমাণে তাদের প্রস্তুতি দেখানোর উদ্দেশ্যে বিবিসিসহ বেশ কিছু সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমার সফরে।

এমনিতে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে খুবই কড়াকড়ি আরোপ থাকে। সাংবাদিকদের ঘুরে দেখানোর জন্য সরকারি তত্ত্বাবধানে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনো কিছুর ছবি তোলা বা ভিডিও করা, স্থানীয় কোনো মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না। এরপরও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্ছেদ করার সব চিহ্নই স্পষ্ট ধরা পড়ছিল সাংবাদিকদের চোখে।

অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, ২০১৭ সালের সংঘাতে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ রোহিঙ্গা গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এখন সেগুলো সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারে ওই সরকারি সফরের বর্ণনা করে বিবিসির দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জোনাথন হেড বলেছেন, কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের লা পো কাউং ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বলা হয়, সেখানে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা থাকতে পারবে। এখানে দুই মাস থাকার পর তারা ফিরে যেতে পারবে স্থায়ী আবাসে। তবে প্রায় এক বছর আগের তৈরির ক্যাম্পটির অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। টয়লেটগুলোর একাংশ ভেঙে পড়েছে। ২০১৭ সালের সংঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাউ রি তু লার এবং থার জায় কোন এই দুই গ্রামে এটি তৈরি করা হয়েছে।

জোনাথানের ভাষায়, ‘যখন আমি ক্যাম্প প্রশাসক সো শি অংয়ের কাছে জানতে চাইলাম তারা কেন গ্রামগুলো ধ্বংস করেছে, তখন তিনি তা অস্বীকার করে জানান, কোনো কিছুই ধ্বংস করা হয়নি। কিন্তু যখন আমি স্যাটেলাইট চিত্রে প্রদর্শিত ছবিগুলোর দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তখন তিনি বলেন, তিনি সবে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাই এর উত্তর তাঁর জানা নেই।’

সাংবাদিকদের এরপর কিয়েন চাউং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শরণার্থীদের জন্য ঘরগুলো জাপান ও ভারতের সরকারের অর্থায়নে তৈরি করা হয়েছে। তবে ক্যাম্পটি তৈরি করার জন্য মিয়ার জিন নামের একটি রোহিঙ্গা গ্রামকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। সীমান্ত পুলিশদের জন্য তৈরি বড় আকারের নতুন ব্যারাকগুলো এই গ্রামের একদম কাছে। নিরাপত্তা বাহিনীর এই ইউনিটদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিল রোহিঙ্গারা। ক্যামেরার আড়ালে গ্রামটি নিশ্চিহ্ন করার কথা স্বীকার করেছেন কিছু কর্মকর্তা।

মূল শহর মংদাউয়ের ঠিক বাইরে অবস্থিত মিও থু গি এ আট হাজারের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস ছিল।

বিবিসির সাংবাদিক জানান, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারি সফরে এসে মিও থু গি গ্রামে তিনি দেখেছিলেন অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বহুতল ভবনগুলো অক্ষত ছিল। রাখাইন গ্রামটিকে ঘিরে প্রচুর গাছ ছিল। এবার গিয়ে দেখেন যেখানে মিও থু গি ছিল, সেখানে এখন বড় আকারে সরকারি ও পুলিশ কমপ্লেক্স। গাছপালাও নেই।

সাংবাদিকদের ইন দিন গ্রামেও নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যার সেই আলোচিত ঘটনাটি এখানেই ঘটেছিল। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে অল্প কিছু নৃশংসতার কথা স্বীকার করেছে, তার মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড রয়েছে। ইন দিনের তিন-চতুর্থাংশ ছিল মুসলিম। বাকিরা রাখাইন বৌদ্ধ। আজ সেখানে মুসলমানের চিহ্নও নেই। যেখানে রোহিঙ্গাদের বাস ছিল, সেখানে এখন কোনো গাছও নেই। সে জায়গায় স্থান করে নিয়েছে কাঁটাতারের বেড়া ও বর্ডার গার্ড পুলিশের নতুন ব্যারাক। সেখানের বৌদ্ধ বাসিন্দারা জানিয়েছে, তাদের পাশে আর কোনোভাবেই তারা মুসলিম চায় না।

সাংবাদিক জোনাথন হেড জানান, ফেরার পথে তিনি ইয়াঙ্গুনে গ্রাম থেকে বিতাড়িত এক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। অনুমতি ছাড়া বিদেশিরা সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করতে পারে না। ওই রোহিঙ্গা তরুণ সাত বছর ধরে একটি শরণার্থীশিবিরে রয়েছেন। ২০১২ সালের সহিংসতায় সিত্তে গ্রাম থেকে বিতাড়িত এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে তিনিও একজন। তিনি জানান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন না। অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরে আসার ঝুঁকি না নিতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বিবিসির তাদের পাওয়া তথ্যের ব্যাপারে জানতে মিয়ানমারের সরকারের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি। মিয়ানমারের মন্ত্রীরা রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে দাবি করে। তাঁদের দাবি, ৭০ বছর ধরে অবৈধ অভিবাসনের স্রোতে তারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ঢুকেছে। তবে এ বক্তব্যের পক্ষে খুব কমই প্রমাণ দেখাতে পেরেছেন তাঁরা।

মিয়ানমারজুড়ে এমন মনোভাব রয়েছে যে রোহিঙ্গারা তাদের নয়। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া এবং অবাধে চলাচলের অধিকার দেওয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সরকার। এর পরিবর্তে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দিতে চায় সরকার। তাদের ভাষায়, এটা নাগরিকত্ব পাওয়ার পথের ধাপ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এই কার্ড গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের মতে, এই কার্ড নিলে তাদের বাঙালি হিসেব শনাক্ত করা হবে।

Share