শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধান : তিন বছরে পাচার হয়েছে ৩২০০ কোটি টাকা

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, রপ্তানি আয় দেশে না আনা, শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান গত তিন বছরে দেশ থেকে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ তথ্য উদ্‌ঘাটন করা হয়েছে। পাচার করা টাকা উদ্ধারে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮১টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৭৮টি। বাকি তিনটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের ঘটনা প্রমাণ হয়েছে। এখন গভীর তদন্ত চলছে। কিছু মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগির চার্জশিট দেওয়া হবে এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

বর্তমান মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বনিম্ন চার বছর ও সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রয়েছে। একই সঙ্গে যে পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ পাচার করা হয়, তার দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রয়েছে। জানা যায়, পাচার করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশির ভাগই রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের। ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অর্থ পাচারের এ ঘটনা ঘটেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে আইন কঠোর হলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলেছে, বর্তমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন আন্তর্জাতিক মানের। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়েছে। যে কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে আশানুরূপ ফল আসছে না।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান আইনটি ২০১২ সালের। এর সাত বছর পর চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বিধি করা হয়। দীর্ঘ সময় বিধিমালা না থাকায় অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে দায়ের করা মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে ধীরগতি চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অর্থ পাচার বাড়লেও অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, পাচারকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, নতুবা পাচার কমবে না।

জানা যায়, আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাই অর্থ পাচার-সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা পরিচালনা করত। ঘুষ-দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধের মধ্যে দুদকের সীমাবদ্ধতা ছিল। এর বাইরেও কর ফাঁকি, মিথ্যা ঘোষণাসহ নানা পন্থায় অবৈধভাবে অর্জিত আয়ের উৎস প্রসারিত হয়। কারণ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ অর্থায়নের বড় উৎস হচ্ছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত আয়, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের জন্য বড় হুমকি। অপরাধের ধরন বিস্তৃত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রচলিত মানি লন্ডারিং আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এতে দুদকের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে সম্পৃক্ত করা হয়। এ ছাড়া ‘যুগপৎ’ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয় সংশোধনী আইনে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, বর্তমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। ফলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় ঝামেলা হয়। একক কোনো সংস্থা কাজ করলে সমস্যা কম হয়- এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন- পুলিশ, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ একাধিক সংস্থা কাজ করায় কে কী কাজ করছে, মামলাগুলোর অগ্রগতি কী- এসব বিষয়ে জানা সম্ভব হয় না। সংস্থাগুলোর মধ্যে পরস্পর যোগাযোগ না থাকায় সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রচলিত আইনে দুদক যেসব মামলা করেছে, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত এবং সাজা হয়েছে। তবে অপরাধীরা এখন জেল খাটছে কি-না বা পুলিশের হেফাজতে আছে কি-না তা বলতে পারব না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৭ ধরনের ‘সম্পৃক্ত অপরাধ’ মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- ঘুষ-দুর্নীতি একধরনের অপরাধ। কেউ অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। এ বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে মামলা করে। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে আন্ডার ইনভয়েস এবং ওভার ইনভয়েস করে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়। এনবিআরের অধীন সংশ্নিষ্ট দপ্তর এ-সংক্রান্ত ঘটনার তদন্ত ও মামলা করে থাকে। আবার কর ফাঁকির মাধ্যমেও টাকা পাচার হয়ে থাকে। এ রকম অপরাধের ধরন দেখে সরকারের একাধিক সংস্থা বর্তমানে কাজ করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান আইন দুর্বল নয়। প্রয়োগে কিছু সমস্যা ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে। অর্থ পাচার-সংক্রান্ত মামলাগুলো কেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয় না জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় দেখা যায় তথ্য আদান-প্রদানে নানা জটিলতা। উপযুক্ত দলিল-দস্তাবেজ না থাকলে আদালত গ্রহণ করে না। এসব কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সারাবিশ্বে মানি লন্ডারিং একটি বড় সমস্যা। তিনি জানান, টাকা দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর এর প্রাথমিক উৎস খুঁজে বের করা কঠিন। ফলে অবৈধ উপার্জনকারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা সম্ভব হয় না। আর অভিযোগ সুনির্দিষ্ট না হলে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা কঠিন।

জানা যায়, বেশি অর্থ পাচার হয়ে থাকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে আন্ডার এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালে ৫৯২ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়, পাচার করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ। পণ্য রপ্তানির আড়ালে ক্রিসেন্ট লেদার, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। এ টাকা দেশে আনা হয়নি। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হয়। ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদেরকে গ্রেপ্তার করা হলেও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে।

অভিযোগ রয়েছে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি করে ৮৭২ কোটি টাকা পাচার করেছে মেসার্স হেনান আনহুই এগ্রো এলসি লি. ও তাদের সহযোগী সাত প্রতিষ্ঠান। একই উপায়ে এক হাজার ১৯৭ কোটি টাকা পাচার করেছে মেসার্স এগ্রো বিডি এবং জেপি লি. ও তাদের সহযোগী আটটি প্রতিষ্ঠান। সূত্র বলেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে হেনান আনহুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার দিদারুল আলম টিটু ও তার সহযোগী কবির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে চালান দেওয়া হয়েছে। এ রকম বহু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

Share