‘হাত ধোয়া’র কথা বলে ‘পাগল’ আখ্যা নিয়ে মরতে হয়েছিল যে চিকিৎসককে

নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : কোভিড-১৯ মহামারী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভাইরাস থেকে বাঁচবার প্রথম উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে হাত ধোয়াকে। ‘World Health Organization’ প্রতিটি মানুষকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার উপর জোর দিতে বলেছে। এখন মানুষ সেটা করছেনও নিয়মিত।

অথচ প্রথম যিনি সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেছিলেন তাঁকে ডাক্তাররা পাগলা গারদে পাঠিয়েছিলেন, সেখানে তাকে প্রায় খুন করা হয়েছিল।

পানি ও সাবানই ভাইরাস সংক্রমণ আটকানোর মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জীবাণু ছড়ানোর বিষয়টি এতো জানা ছিল না। সে সময় হাত ধোয়ার প্রচলনটা ছিলো সেরেমোনিয়াল। বাথরুম থেকে এসে, খাবার আগে, কোনো নোংরা জিনিস ধরার পরে, এমনকি কোনো ক্লিনিক্যাল প্রসিডিউর কিংবা ওটির আগে ডাক্তাররাও হাত ধুতেন না।

হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ প্রথম এ বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন। এই ডাক্তার পিউপেরাল ফিভার, যেটা চাইন্ড বেড ফিভার নামে পরিচিত ছিলো, সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। ১৮৪৬ সালে তিনি একজন ফিজিশিয়ানের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পিউপেরাল সেপসিস এর মধ্যে কানেকশন খোঁজার চেষ্টা করেন।

১৮৪০-এ স্যামেলওয়াইজ যখন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা সাধারণ হাসপাতালে কাজ করছেন, সে সময়ে বহু নারী বাড়িতে প্রসব করতেন। যারা হতদরিদ্র ছিলেন বা যাদের শারীরিক জটিলতা ছিল, তারাই হাসপাতালে প্রসব করতেন। হাসপাতালে প্রসবের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ ভয় পেতেন, তার অন্যতম কারণ ছিল, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে সূতিকা জ্বরে প্রসূতির মৃত্যু হতো। তখন অনেকেই মনে করতেন, বাতাস চলাচলের অভাব ও ভিড়ের কারণেই এভাবে মৃত্যু ঘটে।

ভিয়েনা হাসপাতালে দুটি পৃথক প্রসূতিবিভাগ ছিল। প্রথমটিতে থাকতেন পুরুষ চিকিৎসকরা, দ্বিতীয়টিকে থাকতেন নারী চিকিৎসকরা। ডা. স্যামেলওয়াইজ দেখলেন, পুরুষ ডাক্তাররা যে বিভাগে কাজ করেন, সেখানে সূতিকাজ্বরে নারীদের মৃত্যুর হার দু থেকে তিনগুণ বেশি।

তিনি দেখলেনব পুরুষ ডাক্তার ও ছাত্ররা সকালে অটোপ্সি করবার পর প্রথম বিভাগে এসে রোগী পরীক্ষা করেন ও সন্তান প্রসব করান। দ্বিতীয় বিভাগে কেবল ধাত্রীরাই কাজ করেন এবং তাদের সঙ্গে অন্য কারও সংস্পর্শ ঘটে না। হাসপাতালের প্যাথোলজিস্টের মৃ্ত্যুর পর আরও নিশ্চিত হলেন ডা. স্যামেলওয়াইজ। মৃত্যুর আগে ওই প্যাথোলজিস্ট এক নারীর অটোপ্সি করেছিলেন, যার মৃত্যু হয়েছিল সূতিকা জ্বরে। অটোপ্সির সময়ে ওই প্যাথোলোজিস্টের আঙুল কেটে যায়। প্যাথোলজিস্টের মৃত্যুর আগে তার শরীরে সূতিকা জ্বরের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, তা থেকে স্পষ্ট হলো অন্যরাও এই রোগে পড়তে পারে।

ডা. স্যামেলওয়াইজ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, যেসব ডাক্তাররা ডিসেক্টিং রুম থেকে সরাসরি প্রসূতিবিভাগে আসেন, তারা সূতিকা জ্বরে মৃত নারীদের থেকে ভয়ংকর পার্টিকল নিয়ে আসেন, তা থেকেই সুস্থ নারীরা সংক্রমিত হন এবং তাদের অপমৃত্যু ঘটে।

১৮৪৭ সালে স্যামেলওয়াইজ পুরুষ ডাক্তারদের নির্দেশ দেন প্রসূতি বিভাগে স্বাস্থ্যবতী মায়েদের পরীক্ষা করবার আগে হাত ধুতে হবে এবং তাদের ইনস্ট্রুমেন্টগুলি ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুতে হবে।

এর ফল হল অবিশ্বাস্য। ওই বিভাগে মৃত্যু হার ১৮.২৭ শতাংশ থেকে নেমে এল ১.২৭ শতাংশে। শুধু তাই নয়, ১৮৪৮-এর মার্চ থেকে অগাস্টের মধ্যে একজন নারীরও মৃত্যু হল না।

স্যামেলওয়াইজ এরপর হাত ধোয়ার উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি এই নতুন পদ্ধতি সে সময়ের অনুমোদিত চিকিৎসাজ্ঞানের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর সহকারীরা তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ তাদের মনে হলো ডা. স্যামেলওয়াইজ তত্ত্ব বলতে চায় তারাই, অর্থাৎ চিকিৎসকরাই রোগীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। ভিয়েনা হাসপাতালে মৃত্যুহার কমলেও, হাসপাতালও হাত ধোয়ার তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করল।

উদ্বিগ্ন স্যামেলওয়াইজ খোলা চিঠি লিখলেন চিকিৎসকদের কাছে। হাঙ্গেরিতে ফিরে ১৮৬১ সালে নিজের কাজ প্রকাশ করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। তখনও জীবাণু তত্ত্ব সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সায়েন্টিফিক সোসাইটির লোকজন তখনও বিশ্বাস করতো রোগ বালাই হয় খারাপ আত্মার মাধ্যমে।

স্যামেলওয়াইজ মরিয়া হয়ে সকল গাইনি এন্ড অবসের ডাক্তারদের চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন যেন তারা হাত ধুয়ে, ইনস্ট্রুমেন্টস ধুয়ে কাজ করেন। এতে জীবন বাঁচবে।

হাত ধোয়ার কথা বলার কারণে তখনকার সব চিকিৎসকেরা তাঁকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা দেন।

হাত ধোয়া নিয়ে হাসাহাসি করা লোকজনদের স্যামেলওয়াইজ ‘ইরেসপনসিবল মার্ডারার’ বলতেন। যেকোনো আড্ডাতে ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি এই হাত ধোয়ার থিওরির কথা তুলতেন। সবাই বিরক্ত হতো।

আস্তে আস্তে তিনিও ডিপ্রেশনে পড়তে লাগলেন। সবাই তাকে পাগল মনে করছিল। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউনের পর স্যামেলওয়াইজকে দেয়া হলো ‘মেন্টাল এসাইলামে’। কেউ বললো তাঁর ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, কেউ বললো ‘বদ আত্মা’ ভর করেছে।

মাত্র ১৪ দিন পর, মেন্টাল এসাইলামের গার্ডরা তাঁকে প্রচন্ড পেটালো। পেটানোর ফলে তাঁর হাতে-শরীরে ক্ষত থেকে পচন ধরে। সেখান থেকে তাঁর ডান হাতে গ্যানগ্রিন হয়। রক্তের বিষক্রিয়া হয়ে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৩ আগস্ট, ১৮৬৫ সালে মারা যান এই যুগান্ত সৃষ্টিকারী চিকিৎসক।

ডা. ইগনাজ স্যামেলওয়াইজের মৃত্যুর মাত্র দু বছর পর, বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক জোসেফ লিসার সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে হাত ধোয়া ও ইন্স্ট্রুমেন্ট জীবাণুমুক্ত করার উপর জোর দিলেন। ১৮৭০ সাল থেকে চিকিৎসকরা এ পদ্ধতি গ্রহণ করলেন। ইগনাজ স্যামেলওয়াইজের কাজ লুই পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি।

অথচ মহান এই মানুষটি মৃত্যুর পর দুই থেকে তিনজন তার শেষকৃত্যে আসেন। তাঁর মৃত্যুর কথা ‘হাংগেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটি’ প্রকাশও করেনি তাদের পেপারে।

জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ রোগের উৎপত্তি জীবাণু থেকে হতে পারে আবিষ্কারের অনেক বছর পর তাঁর স্বীকৃতি মেলে। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে তাঁর অনেক বড় স্তম্ভও গড়া হয়েছে।

হাত ধোয়ার মতো সাধারণ ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একজন চিকিৎসককে একঘরে এবং উন্মাদ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল, তাঁকে নিজের জীবনটাও দিতে হয়েছিল সেদিন, আজকের বার বার হাত ধোয়া আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের যুগে দাঁড়িয়ে সে কথা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় বৈকি। অথচ ইতিহাসের নির্মম সত্য এটাই।

করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার অন্যতম পথ বারবার হাত ধোয়া। মানুষ এখন মনে করে বারবার হাত ধুচ্ছেন। এই বিশেষ মুহূর্তে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব এনে দেয়া চিকিৎসক ইগনাজ স্যামেলওয়াইজের প্রতি সম্মান জানিয়ে শুক্রবার (২০ মার্চ) বিশেষ ডুডল প্রকাশ করেছে জায়ান্ট সার্চ ইঞ্জিন গুগল।

Share