আগস্ট পর্যন্ত ব্যাপক হারে বাড়বে : অভিমত বিশেষজ্ঞদের

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর হার বাড়ছেই। বাংলাদেশে আক্রান্ত প্রথম রোগীর খোঁজ মেলে গত ৮ মার্চ; তার ১০ দিনের মাথায় ঘটে প্রথম মৃত্যু। শুরুতে কেবল আইইডিসিআরে পরীক্ষা করার সুযোগ ছিল বলে ভাইরাস বিস্তারের প্রকৃত চিত্র আসছিল না। এপ্রিলের শুরুতে পরীক্ষার আওতা বাড়ার পর দেশে আক্রান্তের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ দেশে ব্যাপক হারে বাড়বে। কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। কত দিনে কমবে তা কেউ বলতে পারে না। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর হয়তো কমতে পারে। ততদিনে দেশের অবস্থা ভয়াবহ হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আরো বলেন, যখন ইবোলা মহামারি দেখা দেয়, তখন পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলায় যত মানুষ মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি মানুষ না খেয়ে মারা যায়। তাই করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিকদের মতামতের ভিত্তিতে সামনে এগোতে হবে। অবৈজ্ঞানিকদের কথা শুনে কোনো লাভ হবে না বরং ক্ষতি হবে। এতে পরিস্থিতির অবনতি হবে। হংকং, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম যেভাবে করোনা মোকাবিলা করেছে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিশেষজ্ঞরা।

১৪ এপ্রিল ২০৯ জন নতুন রোগী শনাক্তের তথ্য দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুলেটিনে, আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয় ১ হাজার ১২ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারে পৌঁছায় ৪ মে। সেদিন ৬৮৮ জনের সংক্রমণ ধরা পড়ায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ১৪৩ জন হয়। অর্থাৎ, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ৫৭ দিনের মাথায় শনাক্ত মোট রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারের ঘরে পৌঁছায়। এরপর ১১ দিনে শনাক্ত হয় ১০ হাজার রোগী। তার পরের সাত দিনে শনাক্ত হয় ১০ হাজার রোগী। এরপর ছয় দিনের মাথায় শনাক্ত হয় ১০ হাজার রোগী। পরের ১০ হাজার রোগী শনাক্ত হতে সময় লাগল আরো কম, মাত্র চার দিন। গতকাল মঙ্গলবার দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৪৪৫ জন। আরেকটি পরিসংখ্যান হলো, ৮ মার্চ পথম শনাক্ত তিন জন। ৪ মে পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয় ১০ হাজার ১৪৩ জন। ১৫ মে পর্যন্ত মোট শনাক্ত ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২২ মে মোট শনাক্ত ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২৮ মে মোট শনাক্ত ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২ জুন পর্যন্ত মোট শনাক্ত ৫২ হাজার ৪৪৫ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাস শনাক্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে প্রতি মিনিটে দুইজন করে আক্রান্ত এবং প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ২ হাজার ৯১১ জন আক্রান্ত হন, মারা যায় ৩৭ জন। গতকাল নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৯১ শতাংশ। সোমবার ছিল ২০ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ পর্যন্ত দেশে মোট ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৭ কোটি মানুষের দেশে আরো অনেকে পরীক্ষার বাইরে থেকে যাওয়ায় আক্রান্ত বা মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। এদিকে করোনা ভাইরাস হুট করে এর ক্ষতিকর ক্ষমতা হারিয়ে নির্বিষ হয়ে যায়নি বলে দাবি করে সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনা ভাইরাসের এখনো শক্তি ক্ষয় হয়নি। করোনা ভাইরাস আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন বাড়বেই। কখন থামবে তা কেউ বলতে পারে না। কেউ কেউ বলেছিলেন, বেশি গরম হলে কমবে, বেশি পানি ভাইরাসকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কমেনি। বাড়তেই থাকবে। নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা প্রয়োজন সেটা করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির বিষয়টি বিবেচনা করে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। তবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ব্যবস্থা নেব। সেই প্রস্তুতিও আমাদের আছে। আর চিকিৎসাসেবা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের সব হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের ৩০ শতাংশেরই উপসর্গ থাকে না। আপনা-আপনি ভালো হয়ে যায়। ভাইরাসটি কখন দুর্বল হয় কেউ বলতে পারে না। তবে নিয়ন্ত্রণের জন্য যা যা প্রয়োজন তাই করতে হবে। কারণ সামনে খুবই কঠিন দিন আসবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, বর্তমানে লঞ্চঘাট ও রাস্তাঘাটের দৃশ্য ভয়াবহ, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। সামনে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। তিনি বলেন, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর হয়তো ভাইরাসটি কমবে। ততদিনে দেশের অবস্থা করুণ হবে। তাই নিজের, পরিবার ও দেশের স্বার্থে সবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

Share