কাস্টমস্ ও ভ্যাট কর্মকর্তারাও করোনাযোদ্ধা

মো. আল আমিন প্রধান : ‘উন্নয়নের অক্সিজেন রাজস্ব,’ একটি দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে সে দেশের অর্থ বা রাজস্বের ওপর। অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কাস্টমস, ভ্যাট ও ইনকাম-ট্যাক্স এর মাধ্যমে রাজস্বের সিংহভাগ অর্জিত হয়ে থাকে। বাজেট প্রণয়ন, উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থা, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ যাবতীয় কাজের পরিকল্পনা ও অর্থের/রাজস্বের যোগান দিয়ে থাকে অর্থমন্ত্রণালয় এর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সরাঞ্জামাদির আমদানি প্রক্রিয়া বেগবান রাখতে বাংলাদেশ কাস্টমস্ ও ভ্যাট কর্মকর্তাগণ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বন্দরসমূহে কর্মরত সন্দেহভাজন কয়েকজনের নমুনা পরীক্ষা করে কভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ এর অধিক ধরা পড়েছে। সবার টেস্ট করা হলে এ সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যাওয়ার আশংকা স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে। তবুও রাজস্ব যোদ্ধারা কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের এ দূর্যোগের সময়েই শুধু নয়, কাস্টমস্ কর্মকর্তাগণ অন্যান্য সময়েও সপ্তাহে সাতদিন, চব্বিশ ঘন্টাই কাজ চালিয়ে যান বন্দরসমূহে। করোনাআক্রান্ত রোগীর সেবা প্রদানের লক্ষ্যে যারা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জীবিকার সংস্থানের জন্যে হলেও রাজস্ব সংগ্রহ কাজ চলমান রাখা অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের জল-স্থল-বিমান বন্দরগুলোতে করোনা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ভেজালমুক্ত কীট, পিপিই, স্যানিটাইজার, মাস্ক ও মেডিকেল সামগ্রীর আমদানি কার্যক্রম সচল রাখতে কাস্টমস্ এর কার্যক্রম সক্রিয় রয়েছে, না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর ও হতে পারত। খুশীর কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার করোনা প্রতিরোধক এসব পণ্য আমদানি শুল্কমুক্ত ঘোষণা দিয়েছে, যার ফলে দ্রুত যাচাই-বাছাই করে পণ্য খালাস ও দেশের অভ্যন্তরে নির্বিঘ্নে প্রেরণের ব্যবস্থা করে আসছেন রাজস্ব কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাগণ রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। যেমন, শিশু খাদ্য ও খাদ্যের কাঁচামাল, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, শিল্পকারখানার মেশিনারি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, কৃষিপণ্য, অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ আরো বিভিন্ন রকমের আমদানি সেনসেটিভ পণ্য পরীক্ষণ ও শুল্কায়নে যেমন দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন তেমনি তৈরিপোষাক, মৎস্য ও কৃষিসহ অন্য রপ্তানিযোগ্য পণ্য পরীক্ষণ ও শুল্কায়নেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এসব পণ্যের অনেক সময় গুণগত মান ও এক্সপায়ার ডেট থাকেনা, যা খেলে শিশুরা হবে রোগা ও মেধাশূণ্য। কীটনাশক, কৃষিজ পণ্য ও বীজ আমদানিতে ভেজাল/নকল পণ্য দেশে এলে সুজলা-সুফলা শষ্য-শ্যামলা উর্বর-দোঁআশ মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন হ্রাস পাবে, গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পকারখানার মেশিনারি নকল আসলে দেশের গার্মেন্টস সেক্টর ও অন্যান্য শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস হবে এবং দেশের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি খারাপ হলে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। এসব কারণে, বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান ধারায় বাধার সৃষ্টি হবে, ফলে কৃষি, শিল্প, চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রে অন্যান প্রতিযোগী দেশগুলোর সূক্ষ্ণ ষড়যন্ত্রের ফলে হোক আর নিজেদের ধ্বংসাত্মক (মুদ্রা পাচার) চিন্তায় হোক, বিদেশে বাংলাদেশের বাজার হারানোর পাশাপাশি নিজেদের টিকে থাকার জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।

অনেক সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পণ্য ছাড়করণের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ায় কাস্টমস্ কর্মকর্তাদের নিয়ে নানা রকম খবর পরিবেশন করে থাকে, যার প্রকৃত ঘটনা অনেকক্ষেত্রে পর্দার অন্তরালেই রয়ে যায়। এর মূল কারণ- পণ্য ছাড়করণের জন্য অসম্পূর্ণ দলিলাদি; বিশেষ করে ওষুধ প্রসাশন, খামারবাড়ি, বিএসটিআই, বুয়েটসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এর অনুমোদনপত্র এবং কান্ট্রি অব অরিজিন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ না থাকলে অনেক সময় পণ্যটি জরুরি হলেও অসম্পূর্ণ দলিলাদির জন্য সাময়িক অসুবিধার কারণে কাস্টমস্ ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের এসব খবর হজম করেই জনগণের নিরাপত্তা ও দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে অবিচল থাকতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া রাজস্ব প্রশাসন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সূচারু দিক-নির্দেশনায় প্রতি বছর রেকর্ড রাজস্ব আদায় করে চলছে। পূর্বের তূলনায় রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মানি লন্ডারিং ও স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধ, কালোবাজারি প্রতিহত, অস্ত্র ও বিস্ফোরক আটক, নেশাজাতীয় ও মাদকজাত দ্রব্য আটক ও ধ্বংস, সীমান্তে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করা, আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য ও সর্বোপরি দেশের চলমান সমৃদ্ধি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এরকম পণ্য আমদানি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছেন চৌকস এ কর্মকর্তাগণ। আমরা মনেকরি চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সাংবাদিকদের মতো তারাও করোনাযোদ্ধা। সময়ের প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা, যানবাহনের সুবিধা, ঝুঁকিভাতা প্রদান, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম গ্রেডে যোগদানের ব্যবস্থা, নির্ধারিত সময়ান্তে প্রমোশনের ব্যবস্থা করা এবং উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সার্কেল অফিস করা হলে ভ্যাট ও শুল্ক কর্মকর্তাগণের যেমন মনোবল বৃদ্ধি পাবে তেমনি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাবে প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক: শুল্ক কর্মকর্তা ও নব-নির্বাচিত প্রতিনিধি, বাকাএভ (বাংলাদেশ কাস্টমস্ এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট এক্সিকিউটিভ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন)

Share