অনুমতি ছাড়াই গ্রেফতার করা যাবে সরকারি কর্মচারীদের

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ফৌজদারি মামলায় সরকারি কর্মচারীদেরকে গ্রেফতারে এখন থেকে পূর্বানুমতি লাগবে না। সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতারের আগে তার নিয়োগকারী কতৃ‌র্পক্ষ থেকে অনুমতি নেওয়ার যে প্রয়োজন হতো সরকারি চাকরি আইনের সেই ধারা বাতিল করে দিয়েছে দেশের উচ্চ আদালত। হাইকোর্ট বলেছে, সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকলেই আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু আইনে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারের আগে অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখায় একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। যা সংবিধান কখনোই সমর্থন করে না। ফলে একটি গোষ্ঠীকে আইনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈষম্য সংবিধান ও আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছে, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে স্পষ্টতই বলে দেওয়া হয়েছে মৌলিক অধিকারের পরিপম্হি ও বৈষম্যমূলক যে কোনো আইন বাতিলযোগ্য। এ কারণে সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতারের পূর্বানুমতির বিধান রেখে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারি চাকরি আইনের ৪১ (১) ধারায় যে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাতিল করা হলো। রায়ে হাইকোর্ট আরো বলেছে, নয় বছর পূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের (দুদক) ৩২(ক) ধারায় সরকারি কর্মচারীদের এমন সুরক্ষা দিয়ে বিধান করা হয়েছিল। সেই বিধানও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি সরকার। এতে প্রতীয়মান হয় যে সরকার ঐ আইন মেনে নিয়েছে। যেহেতু হাইকোর্টের ঐ রায় এখন পর্যন্ত বলবত্ রয়েছে, সেহেতু একই বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নতুন করে কোনো আইন করার সুযোগ নাই বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট।

উচ্চ আদালতের ঘোষিত এই রায়কে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ ধরনের আইন করার কারণে অনেক সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ উঠলেও পূর্বানুমতির নামে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে গ্রেফতার, অভিযোগের তদন্ত ও বিচারেও কালক্ষেপণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ভারতসহ বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই আইনে সরকারি কর্মচারীদের এ ধরনের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার নজির নাই।

এদিকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, অনেক সময় দেখা যায় সরকারি কর্মচারীদের অযথা হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। আর মামলার পর যদি গ্রেফতার করা হয় এবং পরে খালাস পান তাহলে এটা একটা ভোগান্তি। এ ভোগান্তি নিরসন ও সরকারি কাজের সুবিধার জন্য আইনটা করা হয়েছিল। আদালত যে রায় দিয়েছেন তার অনুলিপি পেলে আমরা আপিল করব।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আমি এই রায়কে নিঃসংকোচে সাধুবাদ জানাই। বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশের ফৌজদারি আইনে কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য এ ধরনের সুরক্ষা দেওয়ার বিধান রয়েছে কি না আমার জানা নাই। কারণ সরকারি কর্মচারী বাদে কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে ফৌজদারি আইন সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। সামন্ত যুগে জমিদারের কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া থাকত। সামন্ত যুগের সেই সুবিধাগুলো আমরা ধারণ করে বসে রয়েছি।

২০১৮ সালে সরকারি চাকরি আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়। ঐ আইনের ৪১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কতৃ‌র্ক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে, তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কতৃ‌র্পক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।” সরকারি চাকরি আইনে এই বিধান অন্তভু‌র্ক্তির পূর্বে একই ধরনের সুরক্ষা দিয়ে ২০১৩ সালে দুদক আইনে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ঐ বছরের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাশ হয় দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধন আইন। ঐ আইনের ৩২(ক) ধারায় বলা হয়েছিল, এই আইনের অধীনে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে। ১৯৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে, আদালত সরকারের অনুমোদন ছাড়া মামলা আমলে নিতে পারবে না। আর কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে তা সরকারই নির্ধারণ করে দেবে।

দুদক আইনে এই বিধান অন্তভু‌র্ক্তির পর বিভিন্ন মহল থেকে এর সমালোচনা করা হয়। এমনকি এই আইনের কারণে দুদক ‘নখদন্তহীন বাঘ’-এ পরিণত হবে বলেও তখন আশঙ্কা করেছিলেন অনেকেই। এরপরই ৩২(ক) ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ঐ রিটের রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিধানটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ২০১৪ সালে দেওয়া হাইকোর্টের ঐ রায়ে বলা হয়, কোনো একটি দুর্নীতির ঘটনায় সরকারপ্রধান বা মন্ত্রীদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারী জড়িত থাকলে সরকারপ্রধান বা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। কিন্তু সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে অনুমতি লাগবে। এই পরিস্হিতির সমন্বয় কীভাবে ঘটানো হবে, এর কোনো দিকনির্দেশনা সংশোধিত দুদক আইনে নেই। আইনে এমন পরিস্হিতির সৃষ্টি করাটা অযৌক্তিক। সংশোাধিত ঐ আইন সাধারণ মানুষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচ হবে। যা অসাংবিধানিক। এই রায় বলবত্ থাকার পরেও ২০১৮ সালে সরকারি চাকরি আইন করে সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতারে পূর্বানুমতি সংক্রান্ত ৪১(১) ধারা অন্তভু‌র্ক্ত করে। একই বিধান চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালে রিট করেন মনিজল মোরসেদ। ঐ রিটের রুলের চূড়ান্ত রায়ে হাইকোর্ট ৪১(১) ধারাটি বাতিল ঘোষণা করল হাইকোর্ট।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দুদক কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান বলেন, দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা হাইকোর্টের রায়ে বাতিলের পর কিছু শব্দ পরিবর্তন করে সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারায় সংযুক্ত করা হয়। অথা‌ৎ ৩২(ক) এর নতুন রূপ ৪১(১) ধারা। যেহেতু এই বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সেজন্য হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। রিটকারী পক্ষের কৌঁসুলি মনজিল মোরসেদ বলেন, বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার বিধান বাতিল হওয়ায় এই রায় যুগান্তকারী।

Share