নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : বিলাসবহুল হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে বসে কোটি কোটি টাকা উড়ানো যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়ার বাসায় মিলেছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি, বিপুল পরিমাণ মদ ও নগদ টাকা। গতকাল রবিবার তার ফার্মগেটের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। এর আগে শনিবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশত্যাগের সময় পাপিয়া (২৮) ও তার স্বামী মফিজুর রহমানসহ চার জনকে আটক করে র্যাব-১। এদিকে র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর তাকে যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পাপিয়া নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে এসেছে তার বিলাসবহুল জীবন ও গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল সম্পদের তথ্য।
রাজধানীর গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে সব সময় বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন পাপিয়া। যিনি হোটেলটির বারে বিলবাবদ প্রতিদিন পরিশোধ করতেন আড়াই লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকা ও নরসিংদীতে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ছাড়াও নরসিংদীতে তাদের দুইটি ২ কোটি টাকা দামের প্লট এবং পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়িরও সন্ধান মিলেছে। এই দম্পতি কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে, রাজধানীর ইন্দিরা রোডে পাপিয়া-মফিজুর দম্পতির বাসায় অভিযানের পর সে তথ্য তুলে ধরেছেন র্যাব-১-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, রবিবার দুপুরে ফার্মগেটের ২৮ ইন্দিরা রোডের ঠিকানায় পাপিয়া-মফিজুরের বাসায় অভিযান শুরু করা হয়। ঐ বাসা থেকে নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক বই, কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়। এছাড়া লাইসেন্সবিহীন একটি বিদেশি পিস্তলও পাওয়া যায়। সঙ্গে পাওয়া যায় দুটি ম্যাগজিন ও ২০ রাউন্ড গুলি। পরে বিকালে কাওরান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান তিনি।
লে. কর্নেল বুলবুল বলেন, পাপিয়া ও মফিজুরের সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। কিন্তু খুব অল্প সময়েই তারা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। ইন্দিরা রোডে ‘রওশনস ডমিনো রিলিভো’ নামে বিলাসবহুল ভবনে তাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে নরসিংদীতেও। সেখানে ২ কোটি টাকা দামের দুটি প্লট রয়েছে। কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়াহ ও একটি ভিজেলসহ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তাদের।
র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বিএফডিসির সামনে কার এক্সচেঞ্জ নামে একটি গাড়ির শোরুমে পাপিয়ার ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। নরসিংদী শহরে কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সল্যুশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে এই দম্পতির ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে ও বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন বলেও র্যাবকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন পাপিয়া ও মফিজুর।
র্যাব কর্মকর্তা বুলবুল বলেন, গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট ভাড়া নিয়েছিলেন পাপিয়া-মফিজুর। ৫৯ দিনে মোট ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৮ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন তারা। এর বাইরে হোটেলের বার এককভাবে ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা বিল দিতেন। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের উত্স তারা ঠিকভাবে জানাতে পারেননি।
র্যাবের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাপিয়া-মফিজুরের বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্ত অর্জনের নেপথ্যের কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানান র্যাব সিও। তিনি বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান নরসিংদী এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স ও গ্যাস সংযোগ দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এ পর্যন্ত র্যাবের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাপিয়া-মফিজুর দম্পতি পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নামে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা ও একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেওয়ার নাম করে ২৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তবে টাকার বিনিময়ে কাউকে চাকরি কিংবা পাম্পের লাইসেন্স ও গ্যাসের সংযোগ দিতে পারেননি তারা। তবে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড রয়েছে তাদের, যার মাধ্যমে তারা কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।
শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়া-মফিজুর দম্পতির আয়ের আরো একটি উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা চাকরি দেওয়ার নাম করে নরসিংদী থেকে তরুণীদের ঢাকায় নিয়ে আসত। এরপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের অনৈতিক কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করত। র্যাব কর্মকর্তা আরো বলেন, নরসিংদীতে পাপিয়া-মফিজুর দম্পতির একটি ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। ঐ ক্যাডার বাহিনীর নাম ‘কিউ অ্যান্ড সি’।
র্যাব সিও বলেন, অর্থ পাচার ও জাল মুদ্রা রয়েছে—এমন তথ্যের ভিত্তিতে পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান ও তাদের দুই সহযোগীকে আটক করা হয়। এরপর সব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গেই পাপিয়ার ছবি দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, কোনো অপরাধীর সঙ্গে কারও ছবি থাকা মানেই যে তিনি অপরাধে জড়িত, এমন নয়।
এদিকে পাপিয়া গ্রেফতারের পর নরসিংদীর মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। চতুর সুমন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।