গাজী আবু বকর : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বাংলাদেশকে রিজার্ভের নতুন লক্ষ্য দিয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে বাড়তি সংগ্রহ করতে হবে ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার ‘নিট রিজার্ভ’ ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭৭৮ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮৯ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন বা ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার ও এডিবির ৪০ কোটি ডলার ঋণের অর্থ পাওয়ায় রিজার্ভও কিছুটা বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার দেশের রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৪৬২ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। আর আইএমএফের শর্ত (বিপিএম-৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ ছিলো ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৯১৬ কোটি ৯০ লাখ ২০ হাজার ডলার। আজ রিজার্ভ বেড়ে ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর আইএমএফের শর্ত (বিপিএম-৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক গতকাল রোববার এ তথ্য নিশ্চিৎ করেছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিপিএম ৬ অনুযায়ী হিসাব করা রিজার্ভও বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে নেওয়া কিছু অর্থও দায় হিসেবে বাদ দেওয়া হয়। আরও কিছু খাতের অর্থ নিট রিজার্ভের হিসাবে ধরা যায় না। ফলে এটি দাঁড়ায় ব্যবহারযোগ্য রির্জার্ভে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
গত শুক্রবার বাংলাদেশ নিয়ে আইএমএফের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিশদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে নতুন লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে ৯০০ কোটি ডলারের মতো কমানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা রয়েছে। এতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সংরক্ষণের নতুন লক্ষ্য জানানো হয়। এর আগে সংস্থাটি গত জুনের জন্য একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল। তা বাংলাদেশ পূরণ করতে পারেনি। অবশ্য এতে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৯ কোটি ডলার অনুমোদন করে সংস্থাটি।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের চলতি হিসাবের যে ঘাটতি ছিল, তা কমে আসছে। আমদানি সংকোচন করার নীতি এবং পাশাপাশি রপ্তানি ভালো হওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যে ঘাটতি ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। আইএমএফ বলেছে, প্রথমে কোভিড-১৯ ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর অনেকেই এখনো আর্থিক কঠোরতার মধ্যে রয়েছে। ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারেও বড় ধরনের উত্থান-পতন হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি কঠোর করেছে, বিনিময়হারকে আরও নমনীয় করেছে, প্রচলিত বিনিময় হারগুলোকে একীভূত করেছে এবং আর্থিক নীতিগুলোকে যতটা সম্ভব কঠোর করেছে। অর্থনীতির স্বার্থে মোটা দাগে তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশকে জোর দিতে হবে জানিয়েছে আইএমএফ। সেগুলো হলো কর রাজস্ব বৃদ্ধি; কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় কমানো ও মূল্যস্ফীতি কমানোসহ মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকীকরণ করা এবং ব্যাংক খাতে তদারকি বৃদ্ধিসহ আর্থিক খাতে সংস্কার আনা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ নিয়েছে, তার বেশ কিছু শর্তের মধ্যে একটি হলো বৈদেশিক মুদ্রার নির্দিষ্ট মজুত থাকা। গত জুনের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময় নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের মতো। গত অক্টোবরে নিট রিজার্ভ আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ডলারে। তখন মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি।
আইএমএফের সদস্যদেশগুলো ২০১২ সাল থেকে ব্যালান্স অব পেমেন্টস ও ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। বাংলাদেশ তা করছিল না। আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ গণনায় গত জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিপিএম ৬ অনুযায়ী হিসাব করা রিজার্ভও বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে নেওয়া কিছু অর্থও দায় হিসেবে বাদ দেওয়া হয়। আরও কিছু খাতের অর্থ নিট রিজার্ভের হিসাবে ধরা যায় না। ফলে এটি দাঁড়ায় ব্যবহারযোগ্য রির্জার্ভে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাংলাদেশ পেলেও তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে বেশ কিছু শর্ত পরিপালন করতে হবে। অবশ্য ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের আগে রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দেওয়া শর্তে সংশোধন আনে সংস্থাটি। আগে বলা হয়েছিল চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের শর্ত দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। একই দিন এডিবির ঋণের ৪০ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এ দুই সংস্থার ঋণের টাকা যোগ হওয়ায় গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ২৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২৫ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার ডলারে পৌঁছেছে। যদিও গ্রস রিজার্ভের সঙ্গে নিট রিজার্ভের হিসাবে বড় একটি পার্থক্য রয়েছে।