আট বছরে সাত কোচ—বিসিবি থিতু হবে কবে?

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ২০১১ থেকে ২০১৯। জেমি সিডন্স থেকে রাসেল ডমিঙ্গো। সময়ের হিসাবে আট বছরের কিছুটা বেশি। আর এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে চাকরি করেছেন সাত-সাতজন কোচ। আট বছরে সপ্তম কোচের দেখা পেল জাতীয় দল। জেমি সিডন্স চলে যাওয়ার পর থেকেই কোচের ব্যাপারে থিতু হতে পারছে না বিসিসি।

ঘন ঘন কোচ বদলানো মোটেও ভালো কোনো লক্ষণ নয়। অবশ্য এতগুলো কোচ অদল–বদলে কেবল বিসিবির একার দায় ছিল না। কোনো কোনো কোচ নিজেই দায়িত্বের মেয়াদ পূর্ণ না করে চলে গেছেন। আবার কখনো বিসিবিও ছাঁটাই করেছে। আসলে জাতীয় দলের পারফরম্যান্সের টেকসই উন্নয়নের জন্য যেমন কোচের সময় দরকার হয়, তেমনি কোচ নিজ থেকে যেতে চাইলে বিকল্প পথ দেখা ছাড়া উপায় থাকে না বোর্ডেরও।

বর্তমান জাতীয় দলের ভিত্তি যেসব ক্রিকেটার, তাঁদের সবার উত্থান সিডন্সের আমলে। প্রায় চার বছরের মতো সময় পেয়েছিলেন বলেই ভিত্তিটা গড়তে পেরেছিলেন এই অস্ট্রেলিয়ান। সাকিব-তামিমদের বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ে তোলা সিডন্স থেকে যেতে চেয়েছিলেন কোচের দায়িত্বে। কিন্তু বিসিবি তাঁর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়নি। জয়ের অভ্যাস গড়ে দিয়ে সিডন্স চলে যাওয়ার পর অবস্থা দাঁড়িয়েছে—কোচ আসছে, কোচ যাচ্ছে!

কিন্তু এই আসা-যাওয়ার খেলায় বিসিবি একা কলকাঠি নাড়েনি। সিডন্স থেকে থেকে স্টিভ রোডস—ছয় কোচের মধ্যে শুধু দুজনকে রাখেনি বিসিবি। বাকি চারজন চলে গেছেন নিজের ইচ্ছায়। তবে স্বেচ্ছাবিদায়ী চারজনের দুজন খোলাখুলিই বলেছেন, বিসিবির ওপর অসন্তোষ থেকেই তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশে থাকছেন না।

স্টুয়ার্ট ল (জুলাই ২০১১-মে ২০১২) মাত্র ১০ মাস কোচের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন ‘পারিবারিক কারণ’ দেখিয়ে। ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ থাকলেও আগেই বাংলাদেশ থেকে উড়াল দিয়েছিলেন এ অস্ট্রেলিয়ান। সিডন্সের চলে যাওয়ার প্রভাবটা কিন্তু পড়েছিল স্টুয়ার্ট লয়ের অধ্যায়ে। মাত্র ১০ মাসে কোনো দেশের জাতীয় দলকেই পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। লয়ের সময় ৫ টেস্ট খেলে জয়ের মুখ দেখেনি বাংলাদেশ। হেরেছে ৪ ম্যাচ। ওয়ানডেতে ১৫ ম্যাচে ৫ জয় আর টি-টোয়েন্টিতে ২ ম্যাচে ১ জয়। তবে তাঁর সময়েই বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে গিয়েছিল। ২ রানে সেই ম্যাচটা না হারলে তো এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মুকুটটাই পেত। ল তখন প্রশংসিতও হয়েছিলেন। কিন্তু আর পথ চলতে রাজি হলেন না।

তাঁর পর এলেন রিচার্ড পাইবাস (মে ২০১২-অক্টোবর ২০১২)। বিসিবির সঙ্গে তিক্ততায় ভরা ছিল তাঁর সাড়ে চার মাসব্যাপী কোচিং অধ্যায়। চুক্তিতে সই না করে এ দায়িত্ব পালন করা পাইবাস বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন নিজের ইচ্ছাতেই। এজেন্টের মাধ্যমে বিসিবিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আর বাংলাদেশে আসবেন না। পাইবাসের এ স্বল্প সময়ে আটটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৪ জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। পাইবাস জানিয়েছিলেন, তাঁর চাকরির শর্ত ও কাজে বিসিবি কর্তাদের হস্তক্ষেপে এখানে কোচিং করানোর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর চুক্তির শর্তগুলো মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিসিবির পেশাদারি মনোভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন পাইবাস।

পাইবাসের জায়গা নেন তাঁর ও স্টুয়ার্ট লয়ের সহকারী হিসেবে কাজ করা শেন জার্গেনসেন (ফেব্রুয়ারি ২০১৩-মে ২০১৪)। এক বছর তিন মাসের মতো বাংলাদেশের কোচের দায়িত্বে ছিলেন। জার্গেনসেন নিজ থেকেই দায়িত্ব ছেড়েছিলেন ক্ষোভ আর অভিমান থেকে। বিসিবি অবশ্য তাঁর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। খেলোয়াড়দের মনের মধ্যে ঠাঁই করে নিলেও জার্গেনসেন আশানুরূপ ফল দিতে পারেননি। ৮ টেস্টে ১ জয়, ৩ হার। ওয়ানডেতে ১৬ ম্যাচে ৫ জয় আর টি-টোয়েন্টিতে ১৩ ম্যাচে ৩ জয়। পরিসংখ্যান যা বলছে, তার চেয়েও আসলে বাজে সময় কাটাচ্ছিল বাংলাদেশ।

এরপরই এলেন চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে। ২০১৪ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে লো স্কোরিং এক সিরিজ দিয়ে শুরু হলো যাত্রা। কিন্তু দ্রুতই হাথুরুর অধীনে বাংলাদেশ উন্নতি করতে থাকে। ওয়ানডেতে মাশরাফির অধিনায়ক হিসেবে প্রত্যাবর্তন একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল সন্দেহ নেই। ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া বাংলাদেশ ঘরের মাঠে একে একে ওয়ানডে সিরিজে হারায় পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে। টেস্টেও অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো দলের জয়ের সাহসটা হাথুরুই বুনে দিয়েছিলেন।

হাথুরু নিজেই চুক্তির মাঝপথে দায়িত্ব ছেড়ে শ্রীলঙ্কায় চলে যান। কোচদের দীর্ঘ সময়টা যে সত্যি সত্যিই ভালো পারফরম্যান্সের নিয়ামক, তা সিডন্সের পর প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে (মে ২০১৪-নভেম্বর ২০১৭)। প্রায় সাড়ে তিন বছর কোচ হিসেবে ২১ টেস্টে ৬ জয়, ৫২ ওয়ানডেতে ২৫ জয় আর ২৯ টি-টোয়েন্টিতে ১০ জয় এনে দিয়েছিলেন এ লঙ্কান। আর হাথুরুসিংহের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমীহ আদায়ের ভিতটাও মজবুত হয় বাংলাদেশের। তামিম-সাকিব-মাশরাফিদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে এ সময় পাওয়া গেছে লিটন-সৌম্য-সাকিব-মোস্তাফিজদের। কিন্তু হাথুরুসিংহেও থাকেননি। গত বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ থাকলেও ২০১৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান হাথুরু।

হাথুরুসিংহের মেয়াদে বাংলাদেশ দল মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর এনে দেওয়া সুস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশ দল এগোতে থাকে। স্টিভ রোডস সেই পথ চলেও বেশ ভালো সাফল্যই এনে দিয়েছিলেন। ৮ টেস্টে ৩ জয় আর ৩০ ওয়ানডেতে ১৭ জয়ের পাশাপাশি ৭ টি-টোয়েন্টিতে ৩ জয় পেয়েছিলেন রোডস। তবু বিসিবির মন ভরাতে পারলেন না!

ঘন ঘন কোচ বদল একটা দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্সেই প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করবেন, এমন কোচকে বেছে নেওয়া এবং তাঁর কাজের পরিবেশটাও সুনিশ্চিত করা অভিভাবক হিসেবে বিসিবিরই দায়িত্ব। ডমিঙ্গো আপাতত দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন। দুই পক্ষের মতের ভিত্তিতে সেটি ২০২৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বর্ধিত হতেই পারে।

Share