ইউএনওদের পাত্তা দেন না ওসিরা

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : সরকারের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। আর আইনশৃঙ্খলা বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা হলেন অফিসার ইনচার্জ (ওসি)। সভাপতি হিসেবে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমন্বয় ও তদারকির দায়িত্ব ইউএনওর ওপর। তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে এবং উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির পরামর্শক্রমে কাজ করার কথা ওসির। যদিও দেশের বেশিরভাগ ইউএনও এবং ওসির মধ্যেই কাজের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয় নেই। অধিকাংশ ওসিই পাত্তা দেন না ইউএনওদের।

অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত আগাম তথ্য ইউএনওকে না দিয়ে পরোক্ষভাবে অপরাধীদের আশ্রয় দেন কোনো কোনো ওসি। জেলা পর্যায়ে ডিসি-এসপিদের মধ্যেও এমন দ্বন্দ্ব বিদ্যমান রয়েছে। ফলে মাঠ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্বৃত্তদের দ্বারা হামলার শিকার হচ্ছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।

ইউএনওরা বলছেন, পুলিশ তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করছে না, পরামর্শও নিচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় দ্রুত সাড়া দিচ্ছে না। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন ইউএনওরা।

অন্যদিকে ওসিরা বলছেন, ইউএনওরাই সময়মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তারা শুধু ক্ষমতা চান। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও দোষারোপ করা হয় শুধু পুলিশকে। মাঠ পর্যায়ে কোনো বড় ঘটনা ঘটলেই প্রশাসনের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জনবল সংকটসহ পুলিশের কোনো সমস্যা তারা বুঝতে চান না। পুলিশের ছোটখাটো বিষয়েও তারা শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন।

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনওর ওপর হামলাসহ সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়েছে।

এদিকে ইউএনও সরকারের প্রতিনিধি ও উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হলেও বেশিরভাগ সংসদ সদস্যই তার চেয়ে ওসিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে ওসির অবস্থানই বেশি কার্যকর বলে মনে করেন এমপিরা। একইভাবে উপজেলা চেয়ারম্যানরাও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ইউএনওর চেয়ে ওসিকে বেশি প্রাধান্য দেন। এ সুযোগে ওসিরাও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন পুলিশ সুপার (এসপি) বলেন, এমপিদের সঙ্গে এসপির চেয়ে ওসির যোগাযোগ বেশি। ফলে যেসব ওসি অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না এসপিরা। দুর্নীতিবাজ ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকজন এসপিকেই উল্টো বদলি হতে হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার স্বার্থে ইউএনওর ডাকে সাড়া দেওয়া ওসির আইনগত দায়িত্ব। তবে তার জরুরি কোনো কাজ থাকলে আলোচনা করে ঠিক করে নিতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে কেউ অবহেলা করতে পারে না। এরপরও যদি কেউ অবহেলা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মনিটরিংয়েরও অভাব আছে। অনেক বিষয় আইনে থাকলেও সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ কারণেও সমস্যা হচ্ছে। সবাই যদি আইনানুযায়ী দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে এই সমস্যা হতো না।

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, বর্তমান প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমস্যা পারস্পরিক আস্থা, সহযোগিতা ও সমন্বয়হীতার। তাছাড়া দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার বিষয়েও সম্ভবত অনীহা রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার মানসিকতার অভাব রয়েছে। ওপর থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও সমন্বয়হীনতার ঘাটতি এবং নিচের দিক থেকে আন্তরিক আনুগত্যও সম্ভবত যথাযথভাবে নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নজিরবিহীন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও চাপ।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে হবে। পাবলিক সার্ভিসকে শুধু পেশা নয়, ব্রত হিসেবেও নিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে মাঠ প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তা কর্মদক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও দলেবলে থাকাকেই মুখ্য মনে করছেন। এ কারণে বেশিরভাগ ইউএনও তাদের সততা, নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা ও যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে পারছেন না। অর্থ, লোভ ও ব্যক্তিত্বের দুর্বলতার কারণে অনেক ইউএনও জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।

অন্যদিকে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) পদায়নের ক্ষেত্রেও মেধা এবং যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অনেকে ফিটলিস্টে না থাকলেও ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। ফলে ডিসিরা এখন মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে দেশের জন্য কাজ করার চেয়ে রাজনীতিবিদদের তোয়াজেই বেশি ব্যস্ত। আবার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দেখভাল ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। যা যথাযথভাবে হচ্ছে না। অনেক ইউএনও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে জবাবদিহি করতে আগ্রহী নন। কেউ কেউ উপজেলা পরিষদের অন্যান্য দপ্তর প্রধানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তারা উপজেলার কৃষি, স্বাস্থ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ কিংবা ‘ভাই’ সম্বোধন না করে ‘সাহেব’ বলে থাকেন।

বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বিপিএম (বার) বলেন, ডিসি-এসপি এবং ইউএনও-ওসির মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকলে কোথাও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, কেউ তো ব্যক্তিস্বার্থে কিছু করছেন না। আইন অনুযায়ী সবাই সবার দায়িত্ব পালন করবেন। এ জন্য পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। একে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে গেলেই সমস্যা তৈরি হয়। অথচ এখন সেই দিন নেই যে, এক ক্যাডার অন্য ক্যাডারের ওপর খবরদারি করবে। পরস্পরকে সহযোগিতা করেই এগোতে হবে।

বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেন, সংবিধানের ১১, ৫৯ এবং ১৫২(১) অনুচ্ছেদের নির্দেশনা বাস্তবায়নে উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর ইউএনও সেটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। এর বাইরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পাবলিক পরীক্ষা ও প্রটোকল অফিসার। কিন্তু নির্বাচিত প্রশাসনিক স্তরে টিমওয়ার্কের অভাব ও আইন অমান্যের কারণে সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে।

ইউএনও পদে দায়িত্ব পালন করে আসা কয়েকজন উপসচিব তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, উপজেলায় কাজ করার সময় গোয়েন্দাদের কাছ থেকে আগাম তথ্য তারা খুব কমই পেয়েছেন। অথচ নিজস্ব সূত্র, এমনকি সাংবাদিকদের কাছ থেকে অনেক সঠিক আগাম তথ্য পেয়েছেন তারা। ফলে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হতো।

এ বিষয়ে রংপুর বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞা বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) ও দণ্ডবিধি (পেনাল কোড) অনুযায়ী তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন; আইন অনুযায়ী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করতে বলেন।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) মহাসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, প্রশাসনে উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি হলেন ইউএনও। কারণ, তাদের অনেক দায়িত্ব, কিন্তু ক্ষমতা সীমিত। সাধারণ মানুষ অভিযোগ নিয়ে যান তার কাছে। উপজেলা পরিষদের সব কর্মকর্তার সমস্যাও দেখতে হয় তাকে। যদিও তাদের তেমন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আইন অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তারা বিরাগভাজনও হন। এ জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকিও রয়েছে। সম্প্রতি তাদের সশস্ত্র আনসার দেওয়া হয়েছে।

সিভিল সার্ভিস উইমেন নেটওয়ার্কের (বিসিএসডব্লিউএন) সভাপতি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ প্রশাসনে পুলিশের সাড়া সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য অবশ্যই এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, যেহেতু সব মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে কাজ করে, তাই এ বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দেখছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেন আইনি সহযোগিতা পেতে পারেন, এ জন্য মন্ত্রিপরিষদ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, মাঠ প্রশাসনে নিরাপত্তা শুধু নারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়, এটা পুরুষ-নারী সবার জন্য প্রযোজ্য। তবে নারী কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে দেখভাল করা উচিত।

সিলেট রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ইউএনও যে কোনো বিষয়ে জানালে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র দিয়ে তা নিশ্চিত করা হয়। কারণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা পুলিশের আইনগত দায়িত্ব। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী থানায় ফোর্স না থাকলে জেলা পুলিশ লাইন্সের রিজার্ভ ফোর্সকে পাঠানো হয়। জরুরি কোনো কাজ না থাকলে ওসি নিজেও ইউএনওর সঙ্গে থাকেন। এ ছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পেট্রল ডিউটির টিম ২৪ ঘণ্টায় মাঠে থাকে। জরুরি যে কোনো প্রয়োজনে এ ফোর্সকে কাজে লাগানো হয়। তবে দু’একটা সমস্যা হতেই পারে। এটাকে কমন সমস্যা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। তাছাড়া ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলে যে কোনো এলাকার সমস্যা সমাধানে সংশ্নিষ্ট এলাকার দায়িত্বরত পুলিশ ফোর্সকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ঘোড়াঘাট উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সেখানে পুলিশের কাছ থেকে তারা আগাম কোনো তথ্য পাননি। এ ঘটনার পর ঘোড়াঘাট থানার ওসি আমিরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যাকে গ্রেপ্তার করার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা চুরির ঘটনা, সেই আসাদুল হক এ ঘটনায় জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইউএনওর ওপর হামলার পর সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সবার আগে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই এমন ব্যবস্থা ঠিক হয়নি। তারা অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও শাস্তি পেতে হয় শুধু পুলিশকে।

Share