ইন্টারনেট প্যাকেজের স্বল্পমেয়াদ বেঁধে দেয়া কি অন্যায্য নয়?

মোশারফ হোসেন : ব্যাপারটা যেন অনেকটা এমন- আপনি অলিম্পিকের ১০০ মিটার দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন, অথচ আপনার দুই পায়েই শিকল পরানো! কিন্তু আপনাকে বলা হচ্ছে, এই শিকল পায়ে দৌঁড়েই বিশ্বের দ্রুততম মানব ইতালির লেমন্ট মার্সেল জ্যাকবস-এর ৯ দশমিক ৮০ সেকেন্ডর রেকর্ড ভাঙতে! আমাদের দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে যেন এটাই বাস্তবতা। তাদের গলা ফাটানো প্রচারণা আর প্রতিশ্রুতির শেষ নেই, কিন্তু বাস্তবে তারা যেন অলিম্পিকের শিকল পরিহিত সেই কাল্পনিক দৌঁড়বিদ!

ফলশ্রুতিতে এখনো মোবাইল ইন্টারনেট গতিতে আমরা সুদান, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও উগান্ডার মতো ট্রল করা দেশগুলো থেকেও পিছিয়ে আছি! বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট গতির তুলনামূলক বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ওকলার জুলাই, ২০২১ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ নম্বরে! এতে আমাদের কোনো আপত্তি বা অভিমান নেই। কিন্তু কষ্ট ও ক্ষোভ আছে। কারণ, আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের গ্রাহকদের বলছেন যে তারা গতিতে লেমন্ট মার্সেল জ্যাকবস, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তারা রানিং ট্র্যাকের সর্ব পিছনে থাকা পাঁচজনের একজন! আর এমন ধীরগতির ইন্টারনেট সেবা দিয়েই তারা ড্যাটার প্যাকেজমূল্য নির্ধারণ করছে বিশ্বের অন্যতম উচ্চহারে। এখানেই শেষ নয়, তারা এই ধীরগতির ইন্টারনেট প্যাকেজের মেয়াদও নির্ধারণ করে দিচ্ছে অযৌক্তিক, অন্যায্য ও হাস্যকরভাবে। যে ড্যাটা ঘোষিত গতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সে ড্যাটার আবার মেয়াদ নির্দিষ্ট করা থাকবে কেন?

বিভিন্ন অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত বা অঘোষিত সিদ্ধান্তে সারাদেশের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া বা গতি শুন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনার অভিজ্ঞতা আছে এদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের। এমনটা কয়েকবারই হয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে ওই সময়ে এ্যাক্টিভ ইন্টারনেট প্যাকেজগুলোর বিষয়ে বিটিআরসি বা আইসিটি মন্ত্রণালয়ের কারো পক্ষ থেকেই মোবাইল অপারেটরদের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ফলে ড্যাটা এ্যাভেইলএ্যাভেল থাকা সত্ত্বেও মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে, সেই ড্যাটা ব্যবহার করতে পারেনি দেশের কয়েক কোটি গ্রাহক। ফলে এ অব্যবহৃত ইন্টারনেট প্যাকেজের কোটি কোটি টাকা চলে গেছে অপারেটরদের পকেটে। কিন্তু গ্রাহকদের অভিযোগ করার কোনো জায়গা ছিল না, কারণ অব্যবহৃত মেয়াদোত্তীর্ণ ড্যাটা নিয়ে যে কার্যকর ও গ্রাহকবান্ধব কোনো নীতিমালা নেই। তাই ওই সময়গুলোতে পানিতে গেছে সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মানুষের কোটি কোটি টাকা।

তাছাড়া, আপনি প্যাকেজের মেয়াদ বেঁধে দেয়ার নৈতিক অধিকার তখনই রাখবেন, যদি আপনি ঘোষিত গতি নিশ্চিত করতে পারেন। কিন্তু অপারেটররা কি তাদের গর্বের সাথে ব্যক্ত করা ফোর-জি গতি আদৌ নিশ্চিত করতে পেরেছে? আপনি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ জুম মিটিংয়ে আছেন, কিন্তু হঠাৎ করেই নেটওয়ার্ক ফোর-জি থেকে টু-জিতে চলে গেল, আর আপনি হয়তো মিটিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটাই মিস করে গেলেন। অনলাইন ক্লাসসহ লাইভ স্ট্রিমিংগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া সারাদেশ তো সমহারে ইন্টারনেট গতি উপভোগ করতে পারছেও না। সীমান্তবর্তী এলাকার ইন্টারনেট গতির যে বেহাল দশা সেটা রীতিমতো আদিম যুগের অনগ্রসরতাকেই মনে করিয়ে দেয়। ঘরের ভিতরে কোনো ইন্টারনেট ব্যবহার তো দূরের কথা, কথা বলার মতো মোবাইল নেটওয়ার্কই থাকে না। অনেকের প্রবাসী স্বজনরা প্রবাসের কর্মব্যস্ততা শেষ করে বাংলাদেশে যখন গভীর রাত তখন ফোন দেন হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু বা ম্যাসেঞ্জারে। কিন্তু বাধ সাজে মরার নেটওয়ার্ক! কানেক্টিং…..কানেক্টিং……কানেক্টিং……। বাফারিং…..বাফারিং…..বাফারিং…..! ফলে নিরুপায় হয়ে প্রাইভেসি বিসর্জন দিয়ে, চোর ডাকাতের ভয় মনে নিয়েই রাত বিরাতে ঘরের বাইরে গিয়ে প্রবাসী স্বজনের সাথে কথা বলতে হয় বাড়ির বউটির। কিন্তু ঘরের বাইরে গিয়েও নেটওয়ার্ক ও গতি মেলে না — না শুনা যায় কথা, না দেখা যায় প্রিয় মানুষটির মুখ।

সম্প্রতি আমি ও আমার পরিবারের সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। তাই যখন তখন ডকটাইম এ্যাপে পেইড টেলিমেডিসিন সেবা নিতে হয়েছে। কিন্তু আমার গ্রামীণফোনের সিম ব্যবহার করা মোবাইলে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেলেই ভিডিও ও ভয়েস আটকে বা ভেঙে যেত, ডাক্তার না শুনতে পারতেন রোগীর সমস্যা, আমরা রোগীরা না শুনতে পারতাম ডাক্তারের উপদেশ। অনেকবারই আমার গ্রামীণ ফোনের সিম ব্যবহার করা মোবাইলে রোগী ও রোগের হিস্ট্রি এন্ট্রি করে এপয়েন্টমেন্ট ফি পেমেন্ট করে লগ আউট হয়ে তারপর আমার স্ত্রীর বাংলালিংকের সিম ব্যবহার করা মোবাইল দিয়ে রি-লগইন করে ডাক্তারের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে হয়েছে। কই, গ্রামীণ ফোন না দেশ সেরা নেটওয়ার্ক দেয়? আর আমার বাসাও তো গাও-গেরামে নয়– নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাইনবোর্ড মোড় সংলগ্ন। তাহলে কোথায় আছে গ্রামীণফোনের ফোর-জি নেটওয়ার্ক কভারেজ? আমার ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটের কনফিগারেশন তো আমার স্ত্রীর হ্যান্ডসেটের চাইতেও ভালো।

তাই যাদের ঘোষিত সেবা দেয়ার মুরোদ নেই, তাদের সেবার মেয়াদ নামের খড়্গ কেন গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে? ধরুন, আপনার ব্যাংক একাউন্টে বিদেশ থেকে কেউ এক লাখ টাকা পাঠালেন, ১০ দিন পর টাকা উত্তোলন করতে আপনি ব্যাংকে গেলে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপনাকে জানিয়ে দিল, ‘৫ দিনের মধ্যে টাকা উত্তোলন না করায় টাকা উত্তোলনের মেয়াদ চলে গেছে, আপনার একাউন্টে এখন কোনো ব্যালেন্স নেই!’ – কেমন লাগবে তখন আপনার, মানবেন কি ব্যাংকের এই ভিনগ্রহের বাণী? এটা মানবেন না কেউই, কারণ টাকার অংকটা যে এক লাখ! তাহলে মোবাইল ড্যাটার মূল্য শ’ টাকা বলে কি সেটার অন্যায্য মেয়াদপূর্তি আর ব্যালেন্সবিনাশ আমাদের মেনে নিতে হবে? এভাবে দিনে দিনে কি আমাদের লাখ টাকা খোয়া যাচ্ছে না?

মেয়াদের নামেও তো এতদিন এক ধরনের কৌতুক করা হতো। দিন নয়, মাস নয় — ঘন্টা মেয়াদে ড্যাটা বিক্রি করা হতো! তার মানে হচ্ছে, টাইট মেয়াদের মধ্যে যারা ড্যাটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইতেন, তাদেরকে ড্যাটা কিনে অন্যসব কাম-কাজ বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মোবাইল আর ইন্টারনেট নিয়ে পড়ে থাকতে হতো। এখন এই মেয়াদ যদিও সর্বনিম্ন তিন দিন করা হয়েছে, অনেক অভিযোগ আছে যে, এর আগেই ড্যাটা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই ড্যাটা আর ব্যবহার করা যায় না। কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে অভিযোগ করলে তারা হ্যান্ডসেটের নানা সেটিংসের দোহাই দেয়, লিখিত অভিযোগ করতে বলে!

বর্তমান ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রযুক্তির মতো ইন্টারনেটও মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। কারণ, চার ঘন্টা না খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু ইন্টারনেট ছাড়া চলা যায় না। বলা চলে কর্মঘন্টা বাদ দিলে ঘুম আর ইন্টারনেটেই মানুষ এখন বেশি সময় অতিবাহিত করে। তাই ইন্টারনেট সেবাকে গ্রাহকবান্ধব করার কোনো বিকল্প নেই। তাই এক জিবি পর্যন্ত সব ইন্টারনেট প্যাকেজের সর্বনিম্ন মেয়াদ কমপক্ষে এক মাস, আর এক জিবির ঊর্ধ্বের প্যাকেজের সর্বনিম্ন মেয়াদ কমপক্ষে তিন মাস করা উচিত। একই সাথে গতির পতনের জন্য গ্রাহকদের অপারেটর কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত এবং যতটা সময় নেটওয়ার্ক ডাউন থাকে, ঠিক তত সময়ের জন্য যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্যাকেজ ভ্যালিডিটি এক্সটেন্ডেড করে দেয়া হয়। এমনও দেখা গেছে, ২৪ ঘন্টায় ৫০০ এসএমএস অফার! যে মানুষটি এই অফারের সদ্ব্যবহার করতে চাইবে, সে কি আর ওই সময়ে আর কোনো কামকাজ করতে পারবে? তার তো নাওয়া, খাওয়া এমনকি ঘুমও বাদ দিয়ে দিতে হবে। এসব কারণে দেশে অনেক কর্মহীন অকর্মণ্য মস্তিষ্ক তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। তাই দেশের মোবাইল অপারেটরদের মনোপলি এবং গ্রাহক স্বার্থ ও নৈতিকতা বিরোধী সেবা বন্ধ করতে বিটিআরসি ও আইসিটি মন্ত্রণালয়কে আরো কঠোর হতে হবে। কঠোর না হতে পারলেও অন্তত ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।

লেখক: মোশারফ হোসেন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, মোবাইলঃ ০১৭১৯-৬০৫২৭০, ইমেইল- mosharafmau.200117@gmail.com

Share