নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চলতি বছরের শুরুতে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ছিল সর্বোচ্চ ৯০০ জিবিপিএস; বছর শেষে সেই ব্যান্ডউইথের ব্যবহার গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১০০ জিবিপিএসে। ব্যান্ডউইথের সরবরাহও পর্যাপ্ত আর টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর মানও বেশ ভালো। তারপরও মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড উভয় ক্ষেত্রেই সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না গ্রাহকরা। বিশেষজ্ঞরাও সন্তুষ্ট নন গ্রাহকসেবার মানে।
এ সম্পর্কে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও বলছেন, গ্রাহকসেবার মান নিয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তার মতে, মোবাইল অপারেটররা পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করলেই গ্রাহকসেবার মান এখনকার চেয়ে অনেক উন্নত হবে। ব্রডব্যান্ড সেবার মান বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালাসহ একাধিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন চলছে এবং খুব কম সময়েই এর সুফল পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
গ্রাহকদের অভিযোগ অনেক: জুনায়েদ আলম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। করোনা মহামারির কারণে তাকে ক্লাস করতে হচ্ছে অনলাইনে। তিনি জানান, তার উত্তরার বাসায় ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট দুটোই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সকালে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবায় খুব সমস্যা হয়। বিশেষ করে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে বারবার সংযোগ আসে আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জুম কিংবা ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ- দুই মাধ্যমেই ক্লাস করতে খুব সমস্যা হয়। বিকল্প হিসেবে দুটি মোবাইল অপারেটরের সিমকার্ডেই ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়া আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের পরীক্ষার উদাহরণ দিয়ে ইন্টারনেটের গতিতে ‘এক নম্বর’ দাবি করা অপারেটরের নেটওয়ার্কেও এ সংযোগ এত দুর্বল থাকে যে জুম প্ল্যাটফর্মে ‘ইন্টারনেট কানেকশন আনস্টেবল’ দেখা যায়, সংযোগ পাওয়া যায় না। পেশায় প্রকৌশলী মাসুদুল হক। মহামারির সময়ে তাকেও অধিকাংশ সময় অফিস করতে হচ্ছে বাসা থেকে।
তিনি জানান, সরকারি ভয়েস কলে কথা বলতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক মিনিটের মাথায় কল ড্রপ হয়। আবার ইন্টারনেট সংযোগে গেলে নিম্নগতি আর ‘ফ্লাকচুয়েশন’ (বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন) হওয়ার সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ব্রডব্যান্ডের ক্ষেত্রে কখনও খুব ভালো, আবার কখনও নেটওয়ার্কই থাকে না। আবার রাউটারে নেটওয়ার্ক ফুল দেখালেও প্রকৃতপক্ষে ব্যান্ডউইথ শূন্য থাকে। ফলে কোনো সাইটে ঢোকাই যায় না।
শুধু এ দু’জন নন- প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় প্রায় সব গ্রাহককেই। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ সমকালকে বলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকদের মতামত নেন। তাদের বিবেচনায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সাধারণ গ্রাহকই একই ধরনের অভিযোগ করেন। বিষয়টি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে এবং সংস্থাটির গণশুনানিতেও বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রাহকসেবার মান বাড়েনি।
সেবার মান বাড়ে না কেন: কেন গ্রাহকসেবার মান বাড়ে না- জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, মূল কারণ হচ্ছে গ্রাহকসেবার বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কারও কাছেই আসলে যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। কারণ তারা মনে করছেন, গ্রাহকরা ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ সেবা পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যদি মোবাইল অপারেটররা গ্রাহক অনুপাতে পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গ ব্যবহার না করে, তা হলে তার কারণটা খুঁজতে হবে। শুধু অপারেটর কিংবা শুধু বিটিআরসিকে দায়ী করলেই হবে না। বেতার তরঙ্গের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব অবস্থার বিচারে জাতীয় পর্যায় থেকেই একটি যুক্তিযুক্ত নির্দেশনা কিংবা নীতি আসতে হবে।
তিনি বলেন, ব্রডব্যান্ড সেবায় ইদানীং টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের ডিপিআই ব্যবস্থার সক্ষমতা ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে না। কারণ দেশে যত ডাটা ট্রাফিক প্রবেশ করে, তা ডিপিআই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এর ফলে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহকের বাড়তি চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
সেবাদাতারা যে সমস্যার মুখে: গ্রাহকসেবার মানের অবস্থা খারাপ কেন- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আলাপ হয় একটি মোবাইল অপারেটরের অন্যতম শীর্ষ টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, মোবাইল অপারেটরদের পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গ ব্যবহার না করার বিষয়টি সত্য। সাধারণভাবে উন্নত দেশগুলোতে এক মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ করে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ গ্রাহককে সেবা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সেখানে গ্রামীণ তার বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী ফোনপ্রতি ২০ লাখ গ্রাহকের জন্য এক মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ করেছে। রবি প্রতি ১৩ লাখ গ্রাহকের জন্য এক মেগাহার্টজ এবং বাংলালিংক এক মেগাহার্টজ বরাদ্দ রাখতে পারছে ১২ লাখ গ্রাহকের জন্য। টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যার অনুপাতে বেতার তরঙ্গের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, টেলিটকের ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় নেটওয়ার্কই নেই।
এই টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী বলেন, বেতার তরঙ্গের দাম এত বেশি যে, অপারেটরদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক হিসাবের বিবেচনায় তা যুক্তিসংগত নয়। তাই প্রয়োজন থাকলেও অপারেটররা বেতার তরঙ্গ কিনতে উৎসাহী হচ্ছে না। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে বিপুল পরিমাণ বেতার তরঙ্গ অব্যবহূত অবস্থায় পুরোপুরি মূল্যহীনভাবে পড়ে থাকছে। গ্রাহকসেবার মান বাড়ানোর জন্য বেতার তরঙ্গের দাম যুক্তিসংগত হারে নির্ধারণ করা জরুরি বলে অভিমত দেন তিনি।
এই কর্মকর্তা জানান, ফোরজি চালু হওয়ার পর আরও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুটি অপারেটর সেবার মান বাড়ানোর জন্য তাদের বেতার তরঙ্গের সক্ষমতার প্রায় সবটুকুই মূলত টুজি ও ফোরজির জন্য বরাদ্দ করেছে। ফলে থ্রিজির জন্য বেতার তরঙ্গের ব্যবহার প্রায় শূন্য অবস্থায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে অপারেটরের ফোরজির তুলনায় থ্রিজির বিটিএসের সংখ্যা বেশি, তাদের ক্ষেত্রে কোনো গ্রাহক ফোরজি বিটিএস থেকে থ্রিজি বিটিএসের আওতায় চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ মূলত থাকছে না। যেমন- কোনো গ্রাহক হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে বলতে বনানী থেকে মিরপুর এলাকায় ঢুকলেন। তখন তিনি ফোরজি থেকে থ্রিজি বিটিএসের আওতায় চলে যেতে পারেন। ফলে তার সংযোগটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তিনি কথা বলতে পারবেন না। যদিও গ্রাহক তার হ্যান্ডসেটে তখনও ফুল নেটওয়ার্ক দেখতে পাবেন। বিশেষ করে ঢাকায় এ সমস্যা বেশি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষ এনটিটিএন কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোমের হেড অব রেগুলেটরি অ্যান্ড কমিউনিকেশন আব্বাস ফারুক বলেন, বিটিআরসিতে ফাইবার অ্যাট হোম প্রমাণ করে দিয়েছে, তাদের কাছ থেকে যে সেবা যাচ্ছে তার সার্বিক মান ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। মোবাইল অপারেটরদের সেবার মানের ঘাটতির জন্য এনটিটিএন অপারেটররা দায়ী নয়, এটার প্রমাণ তারা যে কোনো সময় দিতে প্রস্তুত। বরং বিটিআরসি এনটিটিএন সেবার ট্যারিফ নির্ধারণ না করায় এনটিটিএন অপারেটরদের ক্ষতি হচ্ছে।
ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল ইসলাম হাকিম বলেন, সমস্যা হচ্ছে লাইসেন্সবিহীন অনেক আইএসপি আছে, যাদের প্রকৃতপক্ষে সেবা দেওয়ার নূ্যনতম সক্ষমতা নেই। শুধু একটি মাইক্রোটিক রাউটার ব্যবহার করে অপর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ দিয়ে তারা কোনোরকমে সেবা দিচ্ছে। আবার ‘অ্যাকটিভ শেয়ারিং’ নীতি না থাকার কারণেও আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো অবকাঠামো ভাগাভাগি করে সাশ্রয়ী খরচে সর্বোচ্চ সেবার মান নিশ্চিত করতে পারছে না। এ ছাড়া আইএসপিদেরও নির্ভর করতে হচ্ছে এনটিটিএন, আইআইজি অপারেটরদের ওপর। ফলে সবক্ষেত্রে সেবার মান শুধু আইএসপি অপারেটরদের ওপর নির্ভর করছে না।