নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে বুধবার রাত থেকে উপকূলের নদনদী ও বঙ্গোপসাগরে ফের ইলিশ ধরা শুরু হয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে নিষেধাজ্ঞা মানতে ব্যাপক প্রচার, প্রশাসনিক কড়াকড়ি, জেল-জরিমানা সবকিছুরই ব্যবস্থা করা হয়। মৎস্য বিভাগ দাবি করছে, মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি সফল হওয়ায় উৎপাদন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। তবে অভিযানের সফলতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে জেলে ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে। সরকারি সহায়তা বাড়লে এবং পাশের দেশগুলোতেও একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা থাকলে উৎপাদন আরও বাড়বে বলে মনে করেন জেলেরা।
নিষেধাজ্ঞা কেন : ইলিশ গবেষকরা বলছেন, এই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, শুধুমাত্র গত বছরই অন্তত সাত লাখ ৪০ হাজার কেজি ডিম ছাড়া হয়েছে। এর অর্ধেক যদি নিষিক্ত হয় আর তার মধ্যে ১০ শতাংশও যদি বাঁচে, তাহলে ৩৭ হাজার কোটি ইলিশ পোনা বা জাটকা পাওয়া যায়। এবারের মা ইলিশ রক্ষার উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে পানি বেড়ে যাওয়ায় এবার বেশি পরিমাণ ইলিশ নদীতে প্রবেশ করে ডিম ছাড়তে পেরেছে। আশা করছি ইলিশ প্রচুর মিলবে। আর মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সময়টুকু বেশি পেয়েছে। ফলে এখন ধরা পড়া ইলিশের পেটে ডিম থাকবে কম। যা আমরা আশা করছিলাম, তা পেয়েছি। তিনি বলেন, এখন ইলিশের রেনুপোনা এবং জাটকা রক্ষা নিয়ে শঙ্কা আছে। যদি কারেন্ট জাল ব্যবহার না হয় তাহলে ইলিশ উৎপাদন গত বছরের ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টনের চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ উৎপাদন হবে।
বাংলাদেশে ২০০৩-২০০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচি শুরু হয়। ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে-পরে মিলিয়ে ১১ দিনের ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে পূর্ণিমার সঙ্গে অমাবস্যা মিলিয়ে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু হয়। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা এবং নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার কারণে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, বেশি ওজনের ইলিশও এখন পাওয়া যাচ্ছে। দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিন লাখ ৮৭ হাজার টন ইলিশ ধরা হয়েছিল, ২০১৮-১৯ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার টন। ইলিশের গড় ওজন গত তিন বছরে ৩৫০ গ্রাম বেড়েছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, আসলে ইলিশ সারা বছরই ডিম দেয়। তবে এই ২২ দিন ৬০-৭০ ভাগ ইলিশ ডিম দেয়। তাই উপযুক্ত সময় হিসেবে এই ২২ দিনকে ধরা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ২২ দিন ঠিক আছে।
বেপরোয়া জেলেরা : এবারের ইলিশ মৌসুমে যে অভিযোগগুলো পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলেরা নদীতে ইলিশ ধরতে নেমে পড়েছেন। অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলাও হয়েছে।
গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে পাঁচ হাজার ২১৩ জেলেকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বুধবার মৎস্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২০’-এর প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। এতে বলা হয়েছে, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে ১৪ থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আট বিভাগে মোট দুই হাজার ৪১৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এ সময়ে ৪১ টন ইলিশ এবং সাত টন অন্যান্য মাছ আটক করা হয়েছে। মোট ছয় হাজার ৫২৯টি মামলা করা হয়েছে। ৮৯ লাখ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। নৌকা ও জাল নিলামের মাধ্যমে আদায় হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। ২২ দিনে এক কোটি ৩৬ লাখ মিটার কারেন্ট জাল ও অন্যান্য অবৈধ জাল, ২০৪টি ইঞ্জিন চালিত কাঠের বোট ও ৮ হাজার ৪৬ কেজি অবৈধভাবে আহরিত মা-ইলিশ এবং ৫৬৮ জন জেলেকে অবৈধভাবে মাছ ধরার অপরাধে আটক করা হয়। জব্দকৃত মালামালের আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৫৫ কোটি টাকা।
জেলেদের জন্য সরকারি সহায়তা যথেষ্ট নয় : মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হলে জেলেদের জীবিকায় টান পড়ে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের খরচ চালাতে তারা নিষিদ্ধ পথে পা বাড়ান। অবশ্য দেশের ৩৬ জেলার ১৫২টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা পাঁচ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২ জেলে পরিবারের জন্য ২০ কেজি হারে বরাদ্দ চাল দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ সহায়তা অনেক জেলে সময়মতো পান না, কিংবা পেলেও পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া একেবারেই না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন এ পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকে।
তালিকা অনুযায়ী, জেলেদের বরাদ্দের চাল অপর্যাপ্ত বলে দাবি করেছে ঝালকাঠি জেলা মৎস্য বিভাগ। রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুরে প্রত্যেক জেলের জন্য ২০ কেজি করে চাল বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয়েছে ১৭ থেকে ১৮ কেজি করে। লক্ষ্মীপুরের মো. হোসেন, মো. আলী, সালাউদ্দিনসহ ১০-১২ জেলে সরকারি খাদ্য সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করে বলেন, তালিকায় প্রকৃত জেলেদের নাম নেই। জনপ্রতিনিধিরা তাদের পছন্দের লোকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে চাল দিচ্ছেন। অভাব ও দাদন ব্যবসায়ীদের চাপের কারণে অনেক জেলে নিষেধাজ্ঞার সময় মা ইলিশ শিকারে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শুধু নিষেধাজ্ঞা দিলেই হবে না, ইলিশ ধরা ও ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও পর্যাপ্ত সহায়তা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কঠোর হলেও ভারত-মিয়ানমার শিথিল: নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কড়াকড়ি অবস্থানে থাকলেও ভারত ও মিয়ানমার সেই অবস্থানে নেই। ফলে ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গত সোমবার নদী গবেষক সূর্য্যেন্দু দের বরাত দিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বহু চেষ্টাতেও যে নিষেধাজ্ঞা আমরা বাস্তবায়িত করতে পারিনি, বাংলাদেশ তা করে দেখাচ্ছে বছরের পর বছর। জেলেদের রুজিতে যাতে টান না পড়ে, সে জন্য ৪০ কেজি করে চাল দেয় বাংলাদেশ সরকার। যার নিট ফল উৎপাদন বেড়েছে।’
বাংলাদেশ উপকূলের একাধিক জেলে জানান, নিষেধাজ্ঞার সুযোগে গত কয়েক বছর হলো বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ভারতীয় জেলেরা অবাধে মাছ শিকার করে নিয়েছে। এতে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। গত সপ্তাহে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় ‘মা ইলিশ রক্ষায় যৌথ সামুদ্রিক সহযোগিতা’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়ে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছাকাছি অবস্থানরত সব ভারতীয় মাছধরা নৌকাকে ভারতীয় সীমানার দিকে পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশে জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি নেতা রবীন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, তিনটি দেশই যদি একসঙ্গে নিষেধাজ্ঞা না দেয়, তাহলে এটি ভালো ফল আনবে না।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, এবার ইলিশের প্রজনন মৌসুমে আমাদের উদ্যোগ শতভাগ সফল হয়েছে। আমাদের অভিযানের মুখোমুখি যারা হয়েছেন, তাদের একটি স্বার্থান্বেষী মহল নদীতে পাঠিয়েছে। এবার আমাদের পুলিশ ও কোস্টগার্ড কঠোর অবস্থানে ছিল। ফলে পাশের দেশের জেলেরাও বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করতে পারেনি। প্রজনন মৌসুমে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে মন্ত্রী জানান, আজ বৃহস্পতিবার ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। মৎস্য প্রজনন সময়ে নিষেধাজ্ঞা যাতে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে করতে পারে, সেই প্রস্তাব করেছি। প্রজনন সময়ে যৌথভাবে মাছ আহরণ বন্ধ রাখার বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য হয়েছে। আগামীতে মা ইলিশ আহরণ ও জাটকা আহরণ বন্ধে একই সময়ে আমাদের সাথে ভারতও ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া আমাদের সমুদ্র বা উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরা বন্ধ থাকাকালে যাতে অবৈধভাবে কোনো নৌকা বা জাহাজ মাছ ধরতে না পারে সেজন্য ভারতীয় কোস্টগার্ড ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের সাথে যৌথভাবে কাজ করবে।