উত্তরার ফ্ল্যাট থেকে যমজ শিশুসহ উদ্ধার হওয়া ‘মা’ মানুষ দেখলে ভয় পাচ্ছেন

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : উত্তরার ফ্ল্যাট থেকে যমজ শিশুসহ উদ্ধার হওয়া ‘মা’ মানুষ দেখলে ভয় পাচ্ছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটে আসবাব বলতে ছিল শুধু একটা খাট। আর রান্নার উপকরণ শুধু একটু লবণ। বাসায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগও বিচ্ছিন্ন। গত এক মাসে হয়তো এই বাসায় কোনো রান্না হয়নি। এই বাসাতেই ১০ বছর বয়সী যমজ কন্যাশিশুকে নিয়ে থাকতেন এক মা। পুলিশের ভাষ্য, খাবারের অভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে এই নারী ফ্ল্যাটে তিন দিন ধরে অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন।

৫ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ওই বাড়ির ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় পুলিশ দুই যমজ কন্যাশিশু ও তাদের মাকে উদ্ধার করে। তাঁরা এখন চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক বলছেন, এই মা ও মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে। এ জন্য দরকার সহযোগিতা ও সহমর্মিতা।

যমজ দুই শিশু জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর মা ভর্তি আছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দুই যমজ শিশুর মা একা একাই দাঁতব্রাশ করছেন। এরপর নিজের বিছানার কাছে রাখা বোতল থেকে পানি খেয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দেন না, এমনকি কারও দিকে তাকাচ্ছিলেন না তিনি। দেখে মনে হয়, তিনি খুব রেগে আছেন। হাসপাতালের নথিতে এই নারীর বয়স ৩৫ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ার আগে হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) আবতাহির রাহিম ওই নারীর কাছে গিয়ে জানতে চান, তিনি কেমন আছেন? দু-তিনবার প্রশ্ন করার পর রাগান্বিত হয়ে তিনি একবার উত্তর দিয়েছেন, ভালো আছেন।

চিকিৎসক আবতাহির রাহিম বলেন, জিনিসপত্র ছুড়ে না মারলেও এই রোগীর চেহারা ও কথায় আক্রমণাত্মক ভাব থাকে। সারাক্ষণ বিরক্ত হয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে দুই মেয়ে কেমন আছে, তা–ও জানতে চান। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তিনি চিকিৎসক-নার্স সবাইকে সন্দেহ করছেন। একধরনের ভীতি কাজ করছে তাঁর মধ্যে। চিকিৎসক-নার্সদের প্রায়ই বলেন, ‘আপনারা তো আমাকে মেরে ফেলবেন।’

ওই নারীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আবতাহির রাহিম বলেন, ধারণা করা হচ্ছে তিনি দীর্ঘদিন না খেয়ে ছিলেন। ৭ ফেব্রুয়ারি এই হাসপাতালে ভর্তির পর খাবার খেয়েছেন। এতে তাঁর লিভারের নানা জটিলতাসহ রিফিডিং সিনড্রোম দেখা দিয়েছে। পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছে। আর মানসিক সমস্যা আগে থেকেই ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাঁর শারীরিক যে অবস্থা, তাতে মানসিক সমস্যার দিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের চিকিৎসকদের পরামর্শে ওষুধ চলছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলে দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক চিকিৎসার বিষয়টি ভাবা হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধানে যমজ মেয়েদের চিকিৎসা চলছে। বর্তমানে এই চিকিৎসক দেশের বাইরে আছেন। আজ হোয়াটসঅ্যাপে তিনি বলেন, ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি যমজ মেয়েদের দেখে এসেছেন। একজনের বুদ্ধির ঘাটতি আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা অপুষ্টির শিকার। তারা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে, তাতে মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ারই কথা। এখন তারা চিকিৎসক, নার্স বা মানুষ দেখলেই ভয় পাচ্ছে। তারা এখনো মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাই তাদের নিয়ে এখনই তেমন কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলা যায়, তারা নিরাপদে আছে।

ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় ঘরের দরজা ভেঙে প্রায় অচেতন অবস্থায় এই নারীকে উদ্ধার করেছিলেন উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই নারীকে ভয়াবহ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। এই নারীর দু-একজন স্বজনের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জানা গেছে, তাতে পারিবারিক বিরোধে এই নারীর অবস্থা এমন হতে পারে। যে ফ্ল্যাট থেকে এই নারীকে উদ্ধার করা হয়, তার মালিক তিনি নিজেই।

মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উদ্ধারের সময় দুই মেয়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বড় বড় চুলে উকুনসহ বনমানুষের মতো চেহারা হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তির পর মেয়েদের চুল কেটে দেওয়া হয়। গোসল করানো হয়। এখন দেখতে একটু স্বাভাবিক লাগছে।’ পুলিশ মানবিকতার জায়গা থেকে এই মা ও মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এখন পরিবারের সদস্যরা দায়িত্ব নিলে পুলিশের আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

গভীর রাতে ওই ফ্ল্যাট থেকে কান্নার তীব্র আওয়াজ শুনতে পান রাস্তায় টহলে থাকা উত্তরা পূর্ব থানার পুলিশ। পরে ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় মা ও মেয়েদের উদ্ধার করে উত্তরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পরে সেখান থেকে মাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও মেয়েদের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এই নারীর এক ভাই ছাড়াও অন্য দুজন স্বজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। স্বজনেরা বলেছেন, উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের একটি ফ্ল্যাটে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন এ নারী। ২০১৮ সালে এই নারীর আইনজীবী বাবা মারা যান। মেয়েদের জন্মের আগেই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় তাঁর। এরপর পরিবারের সদস্যদের অনেকেই তাঁকে বোঝা হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে উত্তরা ও বনানীর ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে জটিলতা ছিল। এই নারীর বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। সেখানে এক ছেলে আছে। ওই ভাইসহ এই নারীর পাঁচ ভাই। মা এক ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন।

পারিবারিক বিরোধ ও টানাপোড়েন : পারিবারিক জটিলতায় এই নারীর সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের দূরত্ব তৈরি হয়। এই নারীকে যখন ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় তখন তাঁর আশপাশে স্বজন কেউ ছিলেন না।এই নারীকে হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁর আপন এক ভাইসহ কয়েক স্বজন হাসপাতালে গিয়ে এই নারী ও তাঁর মেয়েদের দেখভাল করছেন। দুই হাসপাতালে দুজন আয়া রাখাসহ অন্যান্য খরচও দিচ্ছেন।

এই নারীর এক ভাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁর বোন আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। গত দেড়–দুই বছরে অবস্থার অবনতি হয়। পরিবারের কেউ কেউ এই বোনকে বাড়তি বোঝা হিসেবে দেখতেন। দুই মেয়ের খরচ কে দেবে, তা নিয়েও টানাপোড়েন ছিল। দেশের বাইরে থেকে এক ভাই বোনের জন্য আরেক ভাইয়ের কাছে টাকা পাঠালেও সেই টাকা বোনের হাতে পৌঁছাত না। অবহেলা, ভুল–বোঝাবুঝিসহ নানা জটিলতায় এই বোন একা হয়ে পড়েন। একসময় এক ভাই ও মায়ের সঙ্গে এ বোন থাকলেও পারিবারিক জটিলতার কারণে মা ও ভাই আলাদা থাকা শুরু করেন।

এই ভাই আরও বলেন, তাঁর বোনের যমজ মেয়েদের জন্ম ২০১২ সালে। এর আগেই বোনের স্বামী তাঁকে তালাক দেন। তখন বাবার অসুস্থতাসহ বিভিন্ন জটিলতায় এ তালাক আইনসিদ্ধ (সন্তান পেটে ছিল) হয়েছে কি না, তা নিয়ে পরিবারের সদস্যরা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি। তবে একটা সময় বোনের মেয়েরা স্কুলে পড়ত এবং বোনও স্বাভাবিক জীবনই কাটিয়েছেন।

যমজ দুই শিশুর মায়ের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগে ওই নারীর বিয়ে হয়। অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থাতেই স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। কিছুদিন পরই তাঁর দুই কন্যাশিশু জন্ম নেয়। দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি বাবার কাছেই থাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ওই নারী আর্থিক সংকটে পড়েন। তাঁর দুই শিশুসন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি অনেকটা ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েন।

ভাইদের সঙ্গে দূরত্ব : ওই নারীর এক চাচাতো বোন বলেন, বাবা মারা যাওয়ার আগে উত্তরার ফ্ল্যাটটি ওই নারীর নামে লিখে দেন। তবে বাবা মারা যাওয়ার পরই সমস্যা শুরু হয়। ভাইদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। উত্তরার ওই বাড়িতে ওই নারীর ভাইদের আরও তিনটি ফ্ল্যাট আছে। তাঁরা এখন সেখানে থাকেন না। সর্বশেষ গত আগস্টে এক ভাই ওই বাড়ি ছেড়েছেন। ওই ভাই তাঁদের মাকে সঙ্গে নিয়ে যান। তারপর আর ওই নারীর খোঁজ কোনো ভাই বা স্বজনেরা নেননি।

স্বজনেরা জানান, ওই নারীর চার ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই কানাডাপ্রবাসী, এক ভাই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, এক ভাই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং এক ভাই বিসিএস কর্মকর্তা। তাঁদের নিকটাত্মীয়দের অনেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

পরিবারটির জন্য কারও দায় নেই!: উদ্ধারের পর এই মা ও মেয়েদের পাশে দাঁড়ায় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পারি ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের সহসাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম খান বলেন, উদ্ধারের পর তিনি একবার ফ্ল্যাটটিতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ঘরে চাল ছিটানো ছিল। ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন ছিল না, দুর্গন্ধ ছিল। মা ও মেয়েদের তেমন কোনো কাপড়ও ছিল না। ঘরে আসবাবপত্র এমনকি টিভি-ফ্রিজও নেই। রান্নাঘরের চারপাশে নোংরা, স্যাঁতসেঁতে ছিল। লবণ ছাড়া আর কোনো খাবার ছিল না।

ওয়াসিম খান বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি মেয়েদের একজন এখনো গায়ে কাপড় রাখতে চায় না। আরেকজন সারাক্ষণ হাত-পা ব্যায়ামের মতো নাড়াচাড়া করতে থাকে। দুই বোন নিজেদের মধ্যে যেভাবে কথা বলে, তা অন্যরা বুঝতে পারেন না। পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ এগিয়ে আসায় এখন আর তাঁদের স্বেচ্ছাসেবকদের সার্বক্ষণিক দেখভাল করতে হচ্ছে না। তবে তাঁরা ফলোআপের জন্য হাসপাতালে যাচ্ছেন।

এই নারীর স্বজনেরা বলছেন, এই নারী ও তাঁর শ্বশুরবাড়ির সবাই শিক্ষিত। সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি সেভাবে কখনো প্রকাশ পায়নি। তবে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের বিষয়টি তাঁরা টের পেতেন। এখন সম্পত্তির চেয়েও এই মা ও মেয়েদের পুনর্বাসনের বিষয়টি নিয়েই তাঁরা বেশি চিন্তিত। টেকসই কোনো ব্যবস্থা করা না গেলে এই মা ও মেয়েদের পরিণতি হয়তো এর চেয়েও খারাপ হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।

এই নারীর সাবেক স্বামী কেন দুই মেয়ের দায়িত্ব নেননি, সে প্রশ্ন সামনে এনেছেন স্বজনেরা। এ ছাড়া এই নারী যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেই ভবনের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য বা প্রতিবেশীরা তাঁদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। আর মা ও ভাইদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই।

Share