একজন রাজমিস্ত্রির লেখক হওয়ার গল্প, লিখেছেন ১৪টি বই

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি : বাঁচার তরে লড়ি রে ভাই, বাঁচার তরে লড়ি, পৃথিবী নামক রণাঙ্গনে আমি এক রাজমিস্ত্রি।
ভাবিনি নিজের কথা সাজাই পরের রাজ্য, আছে কি-না খানা পেটে, করি না তা গ্রায্য।

অস্ত্র আমার কর্নি ঊষা পাট্টা শল হাতুড়ি।
পৃথিবী নামের রণাঙ্গনে আমি এক রাজমিস্ত্রি।
তীব্র তাপের সাথে লড়ে রক্ত করি ঘাম।
বিদ্রোহী রাজ্য ছিনিয়ে আনি আরাম।

পেশায় রাজমিস্ত্রি হয়েও অদম্য ইচ্ছার বলে প্রত্যন্ত গ্রামে সাহিত্য চর্চা করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লেখক মো. জমির হোসেন পারভেজ। অভাবের সংসারে যেখানে পেট চালানো দায়, তখনও থেমে নেই তার সাহিত্য চর্চা। এভাবে কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে তিনি লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সম্পদনাসহ ১৪টি বই। তার লেখা প্রায় ৩০টির ওপরে নাটক স্থানীয়ভাবে মঞ্চায়িত হয়েছে।

তার লেখা বইগুলো হলো প্রিয়ার মুখটি চোখে ভাসে, হতাশার প্লাটফর্ম, প্রিয়ার বুকে উড়না, প্রসূতির কান্না, বজ্র কণ্ঠের হুংকার, চৈত্রের আকাশ আগুনে পুড়ে, ৭১ এর রক্ত ক্ষরণ, সে একটি হৃদয়ের প্রত্যাশা ও অভ্যুদয়ের ডাক। সম্পাদনা করেছেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, রাসেল একটি গল্পের নাম নয়, একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু, ছোটদের মুক্তিযুদ্ধে ৭১ গল্প, ছোটদের শেখ হাসিনা। তার বইগুলো প্রকাশ করেছে আঞ্জুমান পাবলিকেশন, সত্য কথা প্রকাশনী, তানিয়া বুক ডিপো ও ইমন প্রকাশনী।

কবি জমির হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুট ইউনিয়নের সেমন্তঘর গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে জমির তৃতীয়। স্কুল জীবন থেকেই তার কবিতা লেখা শুরু। এরপর তিনি একের পর এক লিখে যাচ্ছেন। অভাব অনটনের কারণে এসএসসি পাশ করার পর আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। প্রায় ১০ বছর বন্ধ থাকার পর আবার বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ব বিদ্যালয়ের মাধ্যমে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাশ করেন। অর্থ ও পরিবারের চাপ থাকলেও তিনি থেমে যাননি। লড়াকু সৈনিকের মত অর্থের কষাঘাত স্বত্বেও সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন নিয়মিত।

কথা হয় লেখক ও কবি মো. জমির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার জীবন চলার পথ স্বাভাবিক ছিল না। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। বইটির নাম প্রিয়ার মুখে চোখে ভাসে। এই সময় আমার কাছে একটি টাকাও ছিল না। তখন আমার বাবাকে বলেছিলাম আমার টাকা লাগবে। তখন বাবা কোনো উপায় না পেয়ে সুদের ওপর তিন হাজার টাকা এনে দিয়েছিলেন আমাকে। সেই টাকা দিয়ে বইটা প্রকাশ করি। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমার হতাশার প্লাটফর্ম নামের বইটি প্রকাশ হয়েছিল। তখনও আমার কাছে টাকা ছিল না। তখন আমার বিয়ের আংটি ও স্ত্রীর মাটির ব্যাংকের জমানো টাকা দিয়ে কাব্যগ্রন্থ বইটি বের করি। পরবর্তীতে প্রত্যেকটি বই বের করতে গিয়ে আমার বন্ধুমহল শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে সহযোগিতা করেছে।

তিনি বলেন, একজন রাজমিস্ত্রি হয়েও সংসার চালিয়ে অভাবের দুর্গম পাহাড়ে ওপর থেকেও বেঁচে থাকার যে কষ্ট একমাত্র আমিই বলতে পারি। তারপরও আমি সাহিত্য চর্চা ছেড়ে দূরে সরে যাইনি। না খেয়েও আমি সাহিত্য সাধনা করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, আমি এখন পর্যন্ত নয়টি কাব্যগ্রন্ত্র, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখেছি। সম্পাদনা করেছি পাঁচটির মত বই। আমার লেখা প্রায় ৩০টির ওপরে নাটক স্থানীয়ভাবে মঞ্চায়িত হয়েছে। আরও ১২টির মত বই লেখার কাজ চলছে। বই প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে সরকারিভাবে যদি আমাকে সহায়তা করা হয়, তাহলে আমি আরও বই লিখতে পারব। এছাড়া আমার লাইব্রেরিকে যদি সরকার বই দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেয় তাহলে সাহিত্য সাধনা করে জাতীয় পর্যায়ে যেতে পারব।

জমির হোসেন পারভেজের স্ত্রী সালমা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, আমার বিয়ের সময় শুনেছি তিনি স্কুল জীবন থেকে কবিতা লিখা শুরু করেন। বিয়ের পর তার লেখা একটি বই বের করতে গিয়ে বিয়েতে উপহার পাওয়া স্বর্ণের আংটি বিক্রি করে বইটি বের করেছিলেন। অভাব অনটনে সংসার চললেও আমার স্বামীকে আমি সাহিত্য চর্চায় সহযোগিতা করে যাচ্ছি।

জমির হোসেন পারভেজ শুধু একজন সাহিত্য প্রেমীই নন, অভিনয়েও রয়েছে তার অসামান্য দক্ষতা। তার সম্পর্কে সেমন্তঘর মানব কল্যাণ যুব সংগঠন ও গণ মেধাবিকাশ পাঠ্য গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক মো. মনির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কবি জমির হোসেন পারভেজ একজন সাদা মনের নিরহংকার মানুষ। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি একসঙ্গে লেখক, অভিনেতা ও নাট্য নির্মাতা। আমি তার প্রত্যাশিত সফলতা কামনা করছি।

স্থানীয় লোকজন বলেন, জমির হোসেন পারভেজ একজন লড়াকু সৈনিক। সংগ্রাম করে ও আর্থিক কষাঘাতে তার জীবনটা বড় হয়েছে। স্কুল জীবন থেকে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। মাধ্যমিক পড়াশোনা সময়ে তার লেখালেখি শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তার লেখালেখি যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন আর্থিক সংকটের কারণে লেখালেখি বন্ধ হওয়ার পথে ছিল। পরে প্রবাসী ও গ্রামের লোকজন তাকে বই প্রকাশ করতে আর্থিকভাবে সহায়তা করে। প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করেও তিনি সাহিত্য সাধনা করছেন নিয়মিত।

প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুণী এই ব্যক্তিকে এগিয়ে নিলে দেশের সাহিত্য চর্চা আরও সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন, জমির হোসেন পারভেজ একজন দিনমজুর। যিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেও সাহিত্য চর্চা, গান ও নাটক লিখেন। জানতে পেরেছি, তার এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষানুরাগী করার জন্য লাইব্রেরি স্থাপন করতে চাচ্ছেন। আমরা শিক্ষা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো উৎসাহিত করে আসছি। তিনি যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা করা হবে।

Share