এক ইহুদির খোলাচিঠি, ইসরায়েল আমাদের সঙ্গে মিথ্যা বলেছিল

অ্যামান্ডা গেলেনডার : এই চিঠিটা আমি লিখতে বসেছি আমার প্রিয় ইহুদি স্বজনদের উদ্দেশে। আমার স্ক্রিনে এই এখনো গণহত্যার ছবি ভেসে উঠছে।

আমার হৃদয় নিংড়ানো চিঠি এটি। এই চিঠি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রগাঢ় আহ্বান। বলে দিতে চাই, শতাব্দীজুড়ে চলা অবিচারের মধ্যেও আমরা যেভাবে আমাদের ইতিহাস, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ধরে রেখেছি, তার প্রতি আমার গভীর মমতা আছে।

আপনাদের অনেকের মতো আমিও সিনাগগে যাওয়া-আসা করেছি নিয়মিত। বড় হয়েছি প্রগতিবাদী ‘আমেরিকান জিউইশ’ সমাজের অংশ হয়ে। সংস্কৃতি ও ধর্মকে ধারণ করতে ইসরায়েলকে সমর্থন ও দেশটির সবকিছুর উদ্‌যাপন করতে হবে—এমনটাই মনের গভীরে প্রোথিত হয়েছিল।

আমি যখন কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি, আমার বয়স যখন ১৮ তখনই প্রথম জানতে পারি, অধিকৃত ফিলিস্তিনে আসলে কী চলছে। আমার এক ইহুদি বন্ধু আমাকে একদিন জানাল কীভাবে ইসরায়েল আমাদের নাম ব্যবহার করে অপরাধ করে চলেছে।
আমার বলতে সংকোচ হচ্ছে, তবু স্বীকার করতেই হবে যে আমি ওর কথা শুনেছিলাম; কারণ সে-ও ছিল ইহুদি।

আমার সম্প্রদায় আমাকে বুঝিয়েছিল আমাদের নিরাপত্তা ও ভালো থাকার জন্য ইসরায়েলের টিকে থাকা প্রয়োজন। আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় কেন আরও আগে আমি ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস করলাম না। ফিলিস্তিনিদেরই তাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু সেই শৈশবেই মগজ ধোলাই করা হয়েছিল আমার, তীব্র ভয় দেখানো হয়েছিল। জায়নবাদিতা আবরণ ভেদ করে যত দিন পর্যন্ত না আমি বের হতে পেরেছি, তত দিন পর্যন্ত এই ভয় আমাকে তাড়া করে ফিরেছে।

ফিলিস্তিনি হত্যার রক্তের দাগ পশ্চিমাদের হাতেও সমানভাবে লেগে আছে
আমি যখন প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের বর্বরতা সম্পর্কে জানতে পারি, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার ইহুদি মুরব্বিরা আমাকে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, ইহুদি নৈতিকতা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। তাঁরা বলতেন, সমাজ পরিবর্তন ও পৃথিবী সংস্কারে এসব গুণ প্রয়োজন।

এটা কীভাবে বিশ্বাস করি যে আমার নিজের লোকেরাই আমার কাছ থেকে ইসরায়েলি অ্যাপারথেইড ও দখলদারির কথা গোপন রেখেছিল? আমাকে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলিরা এক খণ্ড ফাঁকা জমিতে দেশ গড়েছিল। জায়নিস্টরা গ্রামকে গ্রাম অভিযান চালিয়ে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, নাকবার সময় সাড়ে ৭ লাখ মানুষকে উৎখাত করেছে—এসব খবর ওরা আমাদের কাছে গোপন রেখেছিল। তারাও কি আমার মতো সদ্যই জানল ওখানে কী ঘটছে?

ইসরায়েলের ক্রমেই বাড়তে থাকা যুদ্ধাপরাধের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলকে সমালোচনা করাই ইহুদিবিদ্বেষ, এ কথা আর বলা চলে না। আর এখনো আমার যেসব ইহুদি বন্ধু পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জায়নবাদী জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তিতে পড়ে আছে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা অর্থহীন।

ইচ্ছে করে যে কথাটা আমাদের কাছে চেপে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিল ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদের একমাত্র ঠিকানা, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা বসবাস করেছে। ইসরায়েল এখনো ফিলিস্তিনিদের তাদের বাসভূমিতে এমনকি বেড়াতে যাওয়ারও অনুমতি দেয় না। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেওয়া একজন ইহুদি হয়েও আমি সেখানে যেতে পারি। এমনকি ওখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাইলে ইসরায়েল আমার সব খরচ বহন করবে এবং ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে চুরি করে নেওয়া জমিতে থাকতে দেবে।
একদা যা শুনেছি তা একসময় মানতে চাইনি। যখন মানতে পেরেছি, তখন ক্ষুব্ধ হয়েছি। যাদের ওপর আমাদের আস্থা ছিল, তারা আমাদের সঙ্গে মিথ্যে বলেছিল। এমনভাবে ধোঁকা দিয়েছিল, যেন আমরা এই অ্যাপারথেইড রাষ্ট্রের সব অপকর্মকে উদ্‌যাপন করেছি। তারা শিশুদের হয়রানি করুক বা আমাদের নামে নির্দয় নির্যাতন চালাক। আমার মতো ইহুদি তরুণদের ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা গণহত্যায় জড়িত করা হয়েছে।

ইহুদিদের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষা দেওয়ার নামে এতকাল ভয়াবহ, অতলস্পর্শী নির্যাতন চালানো হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। যেখানে সত্য হলো, একজন দখলদার তখনই নিশ্চিত শান্তি পান, যখন একজন ফিলিস্তিনির ওপর নির্যাতন হয়। দখলদারের অধীনে নিরাপদ জীবনযাপন অসম্ভব।

আমাদের শেখানো হয়েছিল হলোকাস্টের পর ইহুদিদের জন্য ছোট্ট এক টুকরা আশ্রয়ের নাম হলো ইসরায়েল, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মহামূল্যবান এই বস্তুকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। ইসরায়েল ইহুদিদের জন্য একমাত্র রাষ্ট্র, ইসরায়েল আমাদের আবাসভূমি, ইসরায়েল আমাদের ‘বার্থ রাইট’ (ইহুদি হিসেবে জন্মগ্রহণ করলে ইসরায়েলে যাওয়া-আসা ও বসবাসের যে অধিকার)।

পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থেকেও আমরা এক টুকরা জমির অধিকারী—এমনটাই শেখানো হয়েছিল আমাদের। ইসরায়েল আমাদের জন্য ছিল দ্বিতীয় কিংবা বিকল্প বাসভূমি। কিন্তু ইচ্ছে করে যে কথাটা আমাদের কাছে চেপে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিল ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদের একমাত্র ঠিকানা, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা বসবাস করেছে।

ইসরায়েল এখনো ফিলিস্তিনিদের তাদের বাসভূমিতে এমনকি বেড়াতে যাওয়ারও অনুমতি দেয় না। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেওয়া একজন ইহুদি হয়েও আমি সেখানে যেতে পারি। এমনকি ওখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাইলে ইসরায়েল আমার সব খরচ বহন করবে এবং ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে চুরি করে নেওয়া জমিতে থাকতে দেবে।

আমাকে কখনো বলা হয়নি যে ইসরায়েল টিকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে। ওখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ খননের ক্ষেত্রে ইসরায়েল পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ওখানে ওরা অস্ত্রের পরীক্ষা করে, মার্কিন পুলিশরা প্রশিক্ষণ নেয়। আরও কত কী করে। কেউ আমাকে কখনো বলেনি ইসরায়েলকে জন্ম দিতে ফিলিস্তিনকে হত্যা করা হয়েছে। পাপসের নিচে গণহত্যা হয়েছিল নির্দ্বিধায়, যেন ইহুদিরা একটা চকচকে পরিষ্কার কিছু পায়। যেটা বলা হয়নি তা হলো এটা একটা সামরিক জাতি, যার ভিত্তি পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনি দেহ। বলা হয়নি যে, ইহুদিদের বাসভূমি তৈরি হয়েছিল, সেখানকার আদি বাসিন্দাদের কবরের ওপর।

ইসরায়েল প্রসঙ্গে এই গল্প নতুন কিছু নয়। সারা বিশ্বের উপনিবেশশাসিত মানুষের এ গল্প জানা। শ্রেষ্ঠত্ববাদী শ্বেতাঙ্গরা ঔপনিবেশিক মিথ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বলে বেড়ায়। আদিবাসীদের গণহত্যার যৌক্তিকতা জাহিরে তারা বলে তারা একটা কচ্ছপের দ্বীপে এসে পড়েছিল (উত্তর আমেরিকা)। তারপর বলে, অগ্রগতি, আধুনিকতা, গণতন্ত্রের স্বার্থে ঔপনিবেশিক শক্তিকে ধ্বংস করতে হবে, খুন করতে হবে, গুঁড়িয়ে দিতে হবে সব।

ফিলিস্তিনিরা কোনো ধর্মযুদ্ধ করছে না। তারা স্বাধীনতাসংগ্রাম করছে। ফিলিস্তিনিরা যেচে পড়ে ইহুদিদের ডেকে আনেনি। তাদের নৈতিক ও আইনগত অধিকার আছে দখলদারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। এ ক্ষেত্রে দখলদার বাহিনী কে, সেটা মুখ্য নয়। ইহুদিরা যত দিন ফিলিস্তিন দখল করে রাখবে, তত দিন তারা নিরাপদ জীবন পাবে না। আমাদের একজনের মুক্তি, অন্যের মুক্তির সঙ্গে জড়িত।

ফিলিস্তিনের গণহত্যাকে থামিয়ে দিতে পারে শুধু ইহুদিরাই। আমরা আমাদের লাখ লাখ পূর্বপুরুষের মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারিনি। কিন্তু আর এক দিনও যেন গণহত্যা চলতে না পারে, সে উদ্যোগ নিতে পারি। ইহুদির যন্ত্রণাকে কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের ওপর এই হামলাকে—চলুন আর প্রশ্রয় না দিই। এই জরুরি পরিস্থিতি আমরা যেন এড়িয়ে না যাই।

আপনি যদি নিজেকে একজন বিবেকবান ইহুদি বলে বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে বোঝার চেষ্টা করুন যে এই গণহত্যা, রক্তপাতের কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। কথা বলার সময় এখনই। ইতিহাস কবে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতিপূরণ মেটাবে, সে দিনের অপেক্ষায় থাকা চলে না আর। কারণ স্বজন, আমি যখন আপনার কাছে এই ভালোবাসা আর দ্রোহের চিঠি লিখছি, তখনো আকাশ থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে।

অ্যামান্ডা গেলেন্ডার একজন আমেরিকান–ইহুদি। জায়নবাদবিরোধী লেখক। ২০০৬ সাল থেকে তিনি ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসছেন।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ।

Share