নয়াবার্তা প্রতিবেদক : এনআরবিসি ব্যাংকে তমাল চক্র ৮ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। এই চক্রের হোতা রাশিয়াস্থ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এসএম পারভেজ তমাল। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন শেখ সেলিমের পোষ্যপুত্র ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ২০১৩ সালে লাইসেন্স নিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রবেশ করেন তমাল। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে নানা কৌশলে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেন।
অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ সেলিম, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ পতন হওয়া আওয়ামী সরকারের একাধিক মন্ত্রী, এমপিদের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিশেষ সুবিধায় ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন পারভেজ তমাল। ঘুষের মাধ্যমে বিভিন্ন শাখা, উপশাখায় ছাত্রলীগের প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে ব্যাংকে চাকরি দেন। শেখ সেলিম ও ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ প্রভাবশালী দুজন সাবেক গভর্নরের হাত ধরে ২০১৭ সালে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদটি বাগিয়ে নেন পারভেজ তমাল। এরপর এনআরবিসি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ লোপাটের বেশ কয়েকটি অভিযোগের নথিপত্র অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামসহ বিতর্কিত পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
আওয়ামী লীগের খোলসে আবারও ব্যাংক দখলের পাঁয়তারা : উদ্যোক্তা পরিচালক এনায়েত হোসেন, সারোয়ার জামান চৌধুরী, গোলাম রাব্বানী চৌধুরী, সেলিনা ইসলাম, ইজহারুল ইসলাম হালদার, ইঞ্জিনিয়ার ফরাসাত আলী, সাখাওয়াত আলী, এবিএম আবদুল মান্নান ও সোনাওর আলীসহ অনেকেই গত ১৮ আগস্ট, ২৭ আগস্ট, ৩ সেপ্টেম্বর ও ৯ সেপ্টেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের চলমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের কাছে বেশ কয়েকটি অভিযোগ দাখিল করেছেন। এ ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টার কাছে এবং দুদকেও এনআরবিসির পারভেজ-আদনানসহ অসাধু পরিচালকদের বিরুদ্ধে ওইসব বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে।
ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা অভিযোগ করেন, অর্থ উপদেষ্টার ভাগনে জামাই পরিচয়ে আওয়ামী লীগের খোলসে আবারও কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবাজ এনআরবিসি ব্যাংক দখলের পাঁয়তারা করছে। এটি হলে তমাল-আদনানের ব্যাংক লুটের ধারা অব্যাহত থাকবে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক রক্ষা ও বর্তমান পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, নতুন করে ব্যাংকটিতে তমাল-আদনান সিন্ডিকেটের মদদপুষ্ট ফরাসাত আলী, তৌফিক চৌধুরী ও শহিদুল আহসানের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হলে এনআরবিসি দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ : বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন দফতরে পাঠানো অভিযোগ অনুসারে, পারভেজ তমাল ও তার সিন্ডিকেটের অন্যতম সহযোগী পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামসহ কয়েকজনকে নিয়ে ব্যাংকের সীমাহীন দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য, শেয়ার কারসাজি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও পাচারের প্রমাণ মিলেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডি শাখায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুজন গভর্নর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম ও ভাতিজা ফজলে নূর তাপসের কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো যেসব পরিচালকরা অভিযোগ দিয়েছিলেন তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, তমাল ও আদনান ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও জুয়েল হোসেন শ্রাবণের নেতৃত্বে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দমিয়ে রাখার জন্য সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সম্মানী বাবদ কোটি কোটি টাকা দেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি দেশের আইসিটি সেক্টর লুটের কারিগর যারা, সে রকম প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে তমালের এই লুটপাটের সঙ্গী আদনানের নাম ১৬ নম্বরে রয়েছে।
যেভাবে তমাল সিন্ডিকেটের আবির্ভাব : অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাসাত আলী এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি ও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি-সিলেটের চেয়ারম্যান ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর হাত ধরে ব্যাংকটির যাত্রা শুরু হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দুর্নীতি ও আলোচিত ব্যবসায়ী শহিদুল আহসানের সঙ্গে যোগসাজশে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়। যে কারণে সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ব্যাংক পরিচালনা থেকে অপসারণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যাংকটির দায়িত্ব চলে যায় এমন একজন ব্যক্তির হাতে, যে কি না আগের চক্রের চেয়ে আরও ভয়ংকর।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দমাতে বিপুল অর্থ সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে পারভেজ তমাল ও আদনান ইমামের বিরুদ্ধে। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর সিন্ডিকেটসহ আত্মগোপনে চলে যান তারা। তবে আত্মগোপনে থেকেও বিভিন্ন মাধ্যমে অনলাইনে যুক্ত থেকে ভোল পাল্টে নিজের চেয়ার টিকিয়ে রাখতে তমালসহ ব্যাংকের বিতর্কিত পরিচালকরা নানাভাবে তৎপরতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। এসব কাজে সহযোগিতা করছে তার অনুগত ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট, যারা কোনো না কোনোভাবে তমালের সব অপকর্মের সহযোগী ছিলেন।
এনআরবিসি ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ মহলের ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাংকের অভ্যন্তরে ২০১৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঋণ জালিয়াতি, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, শেয়ার কারসাজি, মানি লন্ডারিং, নামে-বেনামে ভুয়া কোম্পানি সৃষ্টি করে ব্যাংকের টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচার করেছে তমাল ও আদনানরা। শুধু তাই নয়, ভয়ানক তথ্য হচ্ছে-ব্যাংকে গোপন কক্ষে টর্চারসেল খুলে নিরীহ কর্মকর্তাদের নির্যাতন, গ্রাহকের কোম্পানি দখলসহ আর্থিক দুর্নীতির অভয়ারণ্য তৈরি করে এই সিন্ডিকেট। ব্যাংকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাবেক কয়েক সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমেও প্রভাব সৃষ্টি ও ভয়ভীতি সৃষ্টি চালাত এই চক্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত পরিদর্শন ও বিশেষ তদন্ত রিপোর্টেও এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য তমাল ও আদনানের গুরুতর আর্থিক অপরাধ ও মানি লন্ডারিংয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ২০২২ সালে তমালের নেতৃত্বাধীন এই বোর্ড ভেঙে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন। তৎকালীন ডিজি কাজী সাইদুর রহমান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ^াস, তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির ও গভর্নর রউফ তালুকদারসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রভাব বিস্তারের কারণে সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
তমালের স্বেচ্ছাচারিতার সহযোগী ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়া : সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা ও দুদকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, ব্যাংক লুটপাটের অন্যতম সহযোগিতায় ছিলেন তৎকালীন এনটিএমসির মহাপরিচালক সম্প্রতি গ্রেফতার মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। তমালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় জিয়াউল আহসান ব্যাংকের বোর্ডরুমে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে তার লোকজন সাদা পোশাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করে আসছিল। তৎকালীন বোর্ড সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তমাল ও আদনান ব্যাংকের টাকা লুটপাট শুরু করেন। এই লুটপাটে অন্যদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক গভর্নর ফজলে কবির, শেখ সেলিম ও ব্যারিস্টার তাপসের মতো কিছু আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের মাসিক নিয়মিত টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করা হয়।
যেভাবে লোপাট হয় আমানতের অর্থ : কিছু নামীয় বা বেনামি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে নিজস্ব সিন্ডিকেট ব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের ঋণ অনুমোদন ও ছাড় করায় তমাল-আদনান চক্র। যার মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম ও তাদের বিপরীতে দেওয়া ঋণের পরিমাণ হচ্ছে-এনআরবিসি ব্যাংকের বনানী ব্রাঞ্চের ঢাকা এভারগ্রীনের ১২৫ কোটি, আইডিসির নামে ১৫০ কোটি, শেখ সেলিমের অবসাদিয়ান প্রতিষ্ঠানের নামে ৮৭ কোটি, তার আরেকটি প্রতিষ্ঠান তিশতি ফান ও তিশতি ফ্যাশনের নামে ১৫২ কোটি, গুলশান শাখা থেকে নাসা পাইপের নামে ১৫৫ কোটি তুলে নেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এ ছাড়াও ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে ৩০৫ কোটি, হাতিরপুল শাখা থেকে রিলায়েবল বিল্ডার্সের নামে ৩৮৭ কোটি, ফরচুন সুজ নামে ২০৩ কোটি, উত্তরা শাখা থেকে এক্সরা অ্যাপারেলসের নামে ১২৬ কোটি, স্টাইলিস্ট গার্মেন্টসের নামে ১৮৭ কোটি, প্রিন্সিপাল শাখা থেকে এজি এগ্রোর নামে ২১৭ কোটি, শেখ সিমেন্টের নামে ৩৩০ কোটি, ফাস্ট করপোরেশনের নামে ৪৭ কোটি, সালছাবিল আতর ও বোরকা হাউসের নামে ২৯ কোটি, আগ্রাবাদ শাখা থেকে হাবিব স্টিলের নামে ৭৭ কোটি, ধানমন্ডি শাখা থেকে গোল্ডবার্গের নামে ২৩ কোটি, রূপপুর শাখা থেকে পাপারোমার নামে ৫ কোটি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতির অসংখ্য ঋণ জালিয়াতি করা হয়েছে। এ ছাড়াও পূবালী কনস্ট্রাকশনের নামে ৯ কোটি, এনইএস ট্রেডিংয়ের নামে ১৯ কোটি ও লান্টা সার্ভিসেসের নামে ৩ কোটি, উত্তরা শাখা থেকে ১৭টি রফতানিমুখী গার্মেন্টসের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা লুটপাট ও পাচার, এসকেএস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পার্টনারশিপ ব্যাংকিংয়ের নামে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লুটপাট ও ভাগাভাগিসহ মোট ৭ হাজার ৭০৬ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনে অযাচিত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অনুমোদন করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে ব্যাংকটি ধ্বংস করে ফেলেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ আলোচিত ব্যক্তিদের নামসর্বস্ব ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার ৭ রফতানিমুখী গার্মেন্টস ও সোয়েটার কারখানার পলিগন ফ্যাশন লিমিটেড, রিল্যাক্স ফ্যাশন লিমিটেড, ইনসাইড নিট কম্পোজিট লিমিটেড, সাফি নিট লিমিটেড, অ্যাপারেলস লিমিটেড, ইক্সোরা অ্যাপারেলস, ব্লেসিংস নিটওয়্যার লিমিটেড ও সিলভার অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ প্রায় ১৭টি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার অবৈধ ঋণ অনুমোদন, ঋণ জালিয়াতি ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে তমাল ও আদনান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এ-সংক্রান্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে ব্যাংকের অডিট বিভাগের নিজস্ব তদন্ত রিপোর্টেও উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে অভিযোগটির অধিকতর তদন্ত চলছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রায় ২২৬ কোটি টাকার ঘুষ : ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, তমাল-আদনান সিন্ডিকেটের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের মাধ্যমে ব্যাংকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রায় ২২৬ কোটি টাকার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তেও এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ হাজার ৭১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ পেয়েছিল সেই তদন্ত কমিটি। তা ছাড়াও এসব নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ওইসব কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ব্যাংক থেকে বছরে ৬০ কোটি টাকা নিয়ে যায় তমাল-আদনান চক্র। কিন্তু বরাবরের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের বশীকরণের মাধ্যমে এর কোনো সুরাহা না করে বরং তমাল-আদনান চক্রকে অর্থ লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের হাত ধরে চেয়ারম্যান তমাল : জানা গেছে, ব্যাংক লুটে তমালের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে সূচনা হয় সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের ছত্রছায়ায়। গভর্নরের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ফজলে কবিরকে বকশিশ হিসেবে প্রতি বছর পাঠানো হতো কোটি কোটি টাকা হয়। বশীভূত করতে তাকে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি ব্রিফকেস। যেখানে ছিল দুবাই রোজ খ্যাত স্বর্ণের গোলাপ। রাশিয়াতে নিয়ে বিশেষ আতিথেয়তার কারণে তমালকে পুরস্কার হিসেবে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডি শাখার ২০২২ সালের তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও আদনান ইমামের শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলা থাকলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়ন করেনি। গত দুই বছর ধরে সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদারের একমাত্র ভগ্নিপতিকে নিজ ব্যাংকে কোম্পানি সচিব হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন, নিয়মিত মাসোহারা, উপহার-উপঢৌকোন, দামি গাড়ি, ভোগবিলাস, বিদেশ ভ্রমণে খরচ বহনের মাধ্যমে এসব তদন্ত প্রতিবেদন ডিপ ফ্রিজে পাঠিয়ে দিয়েছে তমাল-আদনানরা।
সন্দেহজনক লেনদেন ও শেয়ার কারসাজির সাজানো এজিএম নাটক : তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রিন্সিপাল শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১০১৩৬৪০০০০০০১০, এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এমপ্লয়ীজ প্রভিডেন্ড ফান্ড, প্রিন্সিপাল শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১০১৩৬৪০০০০০০১৩ এবং পারভেজ তমালের বেনামি প্রতিষ্ঠান লানতা সার্ভিসেস লিমিটেড, বনানী শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১৯১৩৩৩০০০০০০৩৫০ মধ্যে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার লেনদেন প্রমাণিত হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রল এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এমপ্লয়ীজ প্রভিডেন্ট ফান্ড, প্রিন্সিপাল শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বরে ০১০১৩৬৪০০০০০০১০ ট্রান্সফার করা হয় এবং সেদিনই ৬০ লাখ টাকা এসএম পারভেজ তমালের বিতর্কিত ও বেনামি প্রতিষ্ঠান লানতা সার্ভিসেস লিমিটেডের বনানী শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বরে ০১২১৩৩৩০০০০০০৩৫০ ট্রান্সফার করা হয়। একই বছরের ২৯ এপ্রিল ৫২৩৫৫৭৬ নম্বর চেকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা ইসলামী ব্যাংকে ট্রান্সফার করা হয়। এই অ্যাকাউন্টগুলোতে এমন সন্দেহজনক লেনদেন নিয়মিত হয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। পারভেজ তমাল এই প্রভিডেন্ড ফান্ডের কোনো অনুমোদন বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ড থেকে নেওয়া হয়নি। তা ছাড়া প্রভিডেন্ড ফান্ডের অর্থ চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ট্রান্সফার করা গুরুতর অপরাধ বলেও জানান ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
আরও জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডি ২০১৬ সালের নভেম্বরে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে বাজেয়াপ্ত ঘোষিত এবিএম আবদুল মান্নানের ৪ কোটি ৭০ লাখ ১ হাজার ৮৮৬ শেয়ারের (পরিশোধিত মূলধনের ৫.৬৭ শতাংশ) মধ্যে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫১১টি স্পন্সর শেয়ার, ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর তমালের ব্যবসায়িক পার্টনার ও আত্মীয় শফিকুল আলম মিথুনের নামে ১ কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৯২ শেয়ার, আদনান ইমামের স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমামের নামে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯০৪টি শেয়ার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানের মেয়ে রেহনুমা আহসানের নামে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৬১৫ শেয়ার অবৈধভাবে ব্লক মার্কেটে বিক্রয়সূত্রে হস্তান্তর করা হয়। এই স্পনসর শেয়ার কেনাবেচা বা হস্তান্তরের জন্য বোর্ডের অনুমোদন লাগলেও তমাল-আদনান চক্র এই বিষয়টিকে ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের সঙ্গে বিশেষ লেনদেনের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নজিরবিহীন জালিয়াতি করে। এসব করার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে এনআরবিসি ব্যাংকটিকেও এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের মতো করেই তমাল-আদনানের কবজায় আজীবন ধরে রাখা।
মূলত পারভেজ তমাল-আদনান ইমাম শেয়ারবাজারের বহুল বিতর্কিত চরিত্র আবুল খায়ের হিরুর সঙ্গে চক্রান্ত করে পারভেজ তমাল, রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু ও আদনান ইমাম পরিকল্পিতভাবে এনআরবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ফরচুন সুজ, জেনেক্স ইনফোসিস, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সসহ বিভিন্ন শেয়ারের লেনদেন ও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারসাজি করেছেন। দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকে এসব মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা যা বলছেন : এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ও কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক ও এনআরবিসি ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তদন্তকারী দলের অন্যতম কর্মকর্তা কামাল হোসেন শিশির বলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পাভেজ তমাল এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান আদনানের বিরুদ্ধে ব্যাংকটিতে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় ২০২২ সালে প্রতিবেদন দাখিলের পরও ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সাবেক গভর্নরসহ তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এনআরবিসির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ওই সময় রিপোর্টটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। এখনও ওই অভিযোগের বিষয়টি ধামাচাপা অবস্থায় আছে। এসব দুর্র্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা না নিলে পরিণতি আরও ভয়ানক হবে বলে মনে করেন তিনি।
বক্তব্য পাওয়া যায়নি তমাল-আদনানের : উপরোক্ত অভিযোগগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের সঙ্গে তাদের মোবাইল ফোন নম্বরে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা দিয়ে রাখলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।