নয়াবার্তা প্রতিবেদক : নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে বেসরকারি ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (এনসিসিবিএল) এর ঋণের ৪ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। ঢাকার তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতে মানি স্যুট মোকাদ্দমায় ডিগ্রী পাবার পর অর্থ জারি মোকাদ্দমা করেও কোম্পানির চেয়ারম্যান পলাতক থাকায় ব্যাংক দীর্ঘ ২৫ বছরেও তাদের অবলোপনকৃত অনাদায়ী টাকা আদায় করতে পারেনি।
এক তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান, রাজধানীর পল্টন মডেল থানার স্থায়ী বাসিন্দা রোকসানা পারভীন এনসিসি ব্যাংকের ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আদালতের গ্রেফতারী পরোয়ানা ধামা চাপা দিয়ে বহাল তবিয়তে নিজ গৃহে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি ঢাকার তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতের ৯/২০০২ নং মানি স্যুট মোকাদ্দমা সূত্রে চলমান ৮৪/২০০৩ নং অর্থ জারি মোকাদ্দমার গ্রেফতারী পরোয়ানাভূক্ত পলাতক আসামী। ২০০৯ সালে তার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। পল্টন মডেল থানার পুলিশ ১৪ বছরেও সেই গ্রেফতারী পরোয়ানা তামিল করতে পারেনি। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঢাকার তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতের চলমান ৮৪/২০০৩ নং অর্থজারি মোকাদ্দমাটি স্থবির হয়ে রয়েছে। অথচ এই পলাতক আসামী রোকসানা পারভীন গত ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ইং তারিখে পল্টন মডেল থানার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত সহকারী পুলিশ কমিশনার (মতিঝিল জোন) এর কার্যালয়ের স্মারক নং- ৬৯/ এসি মতিঝিল) তারিখ- ২৬/০১/২০২৩ খ্রিঃ মূলে স্বশরীরে উপস্থিত হন। অতঃপর তিনি সহকারী পুলিশ কমিশনারের নিকট দীর্ঘ ২ ঘন্টা জবানবন্দী অন্তে লিখিত অঙ্গিকার নামা দিয়েছেন। ধূর্ত এই প্রতারকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানার তথ্য ফাইল চাপা থাকায় সহকারী পুলিশ কমিশনার (মতিঝিল জোন) বুঝতেও পারেননি যে, এই ব্যক্তি তাঁর অধস্তন থানারই গ্রেফতারী পরোয়ানাভূক্ত দীর্ঘ ১৪ বছরের পলাতক আসামী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়াজ গার্মেন্টস, ৩৫/২, কাকরাইল, থানা:- মতিঝিল, জেলা:- ঢাকার ঠিকানা ব্যবহার করে তাদের ২৩৪/১ কঁচুক্ষেত, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঠিকানার কারখানাটি এনসিসি ব্যাংকের মগবাজার শাখায় মর্টগেজ রেখে ১৯৯৮ সালে ২২ লাখ ৯ হাজার ১৪১ ডলার অর্থাৎ তৎকালীন বাংলাদেশী মূদ্রায় ৬৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৪ টাকা মূল্যের পৃথক ৫টি এলসি খোলে। এসব এলসির বিপরীতে শিপিং ডকুমেন্ট আসলে নিয়াজ গার্মেন্টস চট্রগ্রাম বন্দর থেকে মালামাল ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর হঠাৎ নিয়াজ গার্মেন্টস তাদের কঁচুক্ষেত ঠিকানার কারখানা রাতের অন্ধকারে গুটিয়ে ফেলে। পরবর্তী ৪ বছরে এনসিসি ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরৎ না পেয়ে ২০০২ সালে নিয়াজ গার্মেন্টসের নিকট সুদাসলে পাওনা ৮৪ লাক্ষ ১০ হাজার ৫৭৪ টাকার ঋণ আদায়ে ঢাকার বিজ্ঞ যুগ্ন জেলা জজ, তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতে ৯/২০০২ নং মানি মোকাদ্দমা দায়ের করে। এই মোকাদ্দমায় ডিগ্রী পাবার পর এনসিসি ব্যাংক একই আদালতে ৮৪/০৩ নং অর্থ জারী মোকাদ্দমা দায়ের করে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ জারি ৮৪/২০০৩ নং মোকাদ্দমার ডিগ্রী জারি তপসিলের বন্ধকী কারখানা নিয়াজ গার্মেন্টস রাতের আধাঁরে গুটিয়ে ফেলে। এনসিসি ব্যাংকের উক্ত শাখায় বিবাদীদের অন্য কোন জমি বা সম্পত্তি মর্টগেজ নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের টাকা আদায়ে নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যানের দৃশ্যমান সম্পত্তি ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজ ও দেউলিয়া বিষয়ক আদালতের ৪/১৯৯৯ নং মোকদ্দমায় আদালতের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিলো। ফলে এনসিসি ব্যাংকের অর্থ জারি ৮৪/২০০৩ নং মোকাদ্দমায় বিবাদীদের সম্পত্তি ক্রোক করে নিলাম বিক্রয় কার্যক্রম সম্ভবপর হয়নি। এই কারণে ঢাকার বিজ্ঞ যুগ্ন জেলা জজ তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালত বিগত ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ইং তারিখে ফৌজদারী কার্যবিধির ৭৫ ধারায় নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনসহ অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে এনসিসি ব্যাংকের গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু অর্থ জারি মোকাদ্দমায় নিয়াজ গার্মেন্টসের ঠিকানা ৩৫/২ কাকরাইল, থানা;- মতিঝিল, উল্লেখ থাকায় গ্রেফতারী পরোয়ানা তামিল করতে এসে স্থানীয় পুলিশ দেখতে পায় যে, এই ঠিকানায় নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ (প্রাঃ) লিঃ কোম্পানীর কোন অস্তিত্ব নেই এবং পূর্বেও কখনো ছিলোনা। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা সিটি জরিপকালে ৩৫/২ কাকরাইল, থানা;- মতিঝিল, ঢাকা, হোল্ডিং ঠিকানাটি ৩৬/২ কাকরাইল, থানা:- পল্টন, ঢাকা-১০০০ হয়েছে। নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে হাত করে বর্তমান সময় পর্যন্ত গ্রেফতার এড়িয়ে ৩৬/২ কাকরাইল (দ্বিতীয় তলা), থানা:- পল্টন, ঢাকা-১০০০ ঠিকানায় বহাল তবিয়তে বসবাস করছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এনসিসি ব্যাংকের ৮৪/২০০৩ নং অর্থ জারি মোকাদ্দমায় ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর অবধি নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনসহ অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে পুলিশ গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর করতে না পারায় অর্থ ঋণ আদালত ৭৫ নং আদেশে, গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে নথী উপস্থাপন করার নির্দেশ দিয়ে চলমান মোকাদ্দমাটি স্থগিত করে রেখেছেন। ফলে এনসিসি ব্যাংকের বর্তমান সময় অবদি সুদাসলে ৪ কোটিরও অধিক টাকা অনাদায়ী অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ বিষয়ে হালনাগাদ বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য গত বছর ৩ জুলাই ২০২২ ইং তারিখে এনসিসি ব্যাংকের জন সংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এই প্রতিবেদককে ব্যাংকের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের নিকট পাঠান। সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষন বিভাগের প্রধান হালনাগাদ তথ্য দিতে ব্যর্থ হন। তিনি এই প্রতিবেদককে এনসিসি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাকের নিকট পাঠান। গত বছর ২ অক্টোবর ২০২২ ইং তারিখে এনসিসি ব্যাংকের মগবাজার শাখার তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক হারুনুর রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য দিতে ব্যর্থ হন। অবশেষে এই প্রতিবেদক ঢাকার বিজ্ঞ যুগ্ন জেলা জজ তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালত হতে ৮৪/২০০৩ নং অর্থ জারি মোকাদ্দমার সকল রায়ের অনুলিপি সংগ্রহ করে হালনাগাদ বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেন। অতঃপর এই প্রতিবেদক গত ১ ফেব্রæয়ারি তথ্য অধিকার আইনে উপ-পুলিশ কমিশনার মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন বরাবর এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে একটি আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, “বিজ্ঞ জেলা জজ তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালত, ঢাকা’র অর্থ জারি ৮৪/২০০৩ নং মোকাদ্দমায় বিবাদী রোকসানা পারভীন, চেয়ারম্যান, নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লিমিটেড, সাবেক ৩৫/২ কাকরাইল, থানা:-মতিঝিল, ঢাকা, বর্তমানে ৩৬/২ কাকরাইল, থানা:-পল্টন, ঢাকা-১০০০ এর বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ৭৫ ধারায় জারিকৃত গ্রেফতারী পরোয়ানাটি বিগত ২৬/০১/২০০৯ ইং তারিখে পল্টন থানায় রেকর্ড ভুক্ত হয়। অর্থ জারি ৬৪/০৯ গ্রেফতারী পরোয়ানাটি বিগত ২০/১১/২০১৭ ইং তারিখ অবধি কার্যকর না হওয়ায় বর্ণিত বিজ্ঞ আদালত এই মর্মে আদেশ দেন যে, ‘গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে নথী উপস্থাপন করা হউক।’ অর্থাৎ মোকাদ্দমাটি বর্তমানে চলমান অবস্থায় গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর না হওয়ায় বিগত ৪ বছরের অধিক সময় স্থগিত রয়েছে।” আবেদনে, তথ্যানুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের স্বার্থে উক্ত গ্রেফতারী পরোয়ানাটি বর্তমানে কি অবস্থায় আছে এবং পরোয়ানাটি কার্যকর করণে কোন আইনগত বাঁধা আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। উপ-পুলিশ কমিশনার মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন কার্যালয় গত ১৩ ফেব্রæয়ারি স্মারক নং- ডিএমপি/এমএন্ডপিআর/১১৭ এর মাধ্যমে আবেদনটি উপ-পুলিশ কমিশনার মতিঝিল বিভাগ বরাবরে প্রেরণ করেন। উপ-পুলিশ কমিশনার মতিঝিল বিভাগ গত ১৪ ফেব্রæয়ারি স্মারক নং-৭৬৮/ডিসি/১৪ এর মাধ্যমে আবেদনটি পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু অদ্যাবধি এ বিষয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন এর দপ্তর থেকে এই প্রতিবেদককে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। এনসিসি ব্যাংকের মগবাজার শাখার বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক আহসান তারিক গত ১৭ জুলাই এই প্রতিবেদকের নিকট হতে ব্যাংকের উক্ত শাখা হতে নিয়াজ গার্মেন্টসকে দেয়া ঋণের টাকা অদায়ে চলমান ৮৪/২০০৩ নং অর্থ জারি মোকাদ্দমার সর্বশেষ হাল নাগাদ বিস্তারিত তথ্য অবগত হন। অতঃপর তিনি পরবর্তী আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের দিক নির্দেশনা চেয়েছেন।
অন্যদিকে এই প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনে উপ-পুলিশ কমিশনার মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন বরাবর তথ্য চেয়ে আবেদন করার পর স্থানীয় থানার পুলিশ নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনের ৩৬/২ কাকরাইল, থানা:-পল্টন, ঢাকা-১০০০ ঠিকানায় খোঁজ খবর নেন। এর পর থেকে রোকসানা পারভীন গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পলাতক রয়েছেন। তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে এই প্রতিবেদক নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনের বক্তব্য জানার জন্য রোকসানা পারভীনের ম্যাসেঞ্জারে ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করে এবিষয়ে বক্তব্য জানানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু কোম্পানির চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন অদ্যাবধি কোন বক্তব্য প্রদান করেননি।