কাকরাইলে মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর ভবন গ্রাস প্রচেষ্টায় পুণরায় প্রতারণা’র আশ্রয় নিলেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ

আবু বকর : এক সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রাজধানীর কাকরাইলে মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর ভবন গ্রাস প্রচেষ্টায় পুণরায় নতুন করে প্রতারণা’র আশ্রয় নিয়েছেন।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও তপশিল সম্পত্তির বিবরণ জালিয়াতি করে আলোচিত এই ভবন গ্রাস প্রচেষ্টায় নিন্ম আদালতের জাল নিলাম ও নিলাম পরবর্তী সকল আদেশ ইতিমধ্যে মহামান্য হাইকোর্ট বাতিল করেছেন। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান মিঞা এবং বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীম এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ১২ মার্চ এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করেন। এই জালিয়াতির সাথে জড়িত অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ সুলতান আহম্মেদ মিঞাকে সরকারি রিসিভারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করার জন্যেও হাইকোর্ট নিন্ম আদালতকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদেশে মহামান্য হাইকোর্ট নিলাম ক্রেতাকে অবিলম্বে বাড়িটির দখল বাড়ির মূল মালিকের নিকট বুঝিয়ে দেবারও নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আলোচিত সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার জজ এর নিকট ৩৬২/২০২০ নং সি এম পি দাখিল করেছেন। যা শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। হাইকোর্টে দাখিলকৃত রিট আবেদন এবং শুনানীর অপেক্ষায় থাকা সি এম পি ফাইল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রিট আবেদনের সাথে সংযুক্ত সকল দলিলাদি দাখিলকৃত সি এম পি ফাইলে সংযুক্ত করা হয়নি। রিট আবেদনের যে সব দলিলাদিতে সরকারি রিসিভারের দায়িত্বে অবহেলা এবং প্রমানিত জালিয়াতির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে সেসব অংশ সি এম পি ফাইলে সংযুক্ত করা হয়নি। অর্থাৎ রিট আবেদনের দলিলাদির ঐসব অংশ বাদ দিয়ে সি এম পি ফাইল করা হয়েছে। অথচ নিয়মানুযায়ী রিট আবেদনের সকল দলিলাদি সি এম পি ফাইলের সাথে সংযুক্ত করার কথা।

এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ৫০৩৮/২০১৯ নং রিট মামলায় রায়ের নির্ধারিত দিনে গত ১২ মার্চ বৃহষ্পতিবার হাইকোর্ট রিটটি নিষ্পত্তি করে আদেশ ঘোষণা করেন। ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে জাল নিলাম কার্যক্রমের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর ৬ তলা ভবন গ্রাসের প্রক্রিয়ায় জড়িত আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ শেষ পর্যন্ত এই জালিয়াতির বিষয়ে নির্দেশ অনুযায়ী মহামান্য হাইকোর্টে সত্য পাঠ যুক্ত লিখিত জবাব দাখিল করেননি। আদেশে হাইকোর্ট সরকারি রিসিভারকে তার নিকট গচ্ছিত নিলাম মূল্যের এক কোটি বিশ লাখ টাকার সাথে ৬ শতাংশ সুদ সহ সমুদ্বয় টাকা ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে জমাপ্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছেন। ঐ টাকা থেকে নিলাম ক্রেতার এক কোটি বিশ লাখ টাকা ফেরৎ প্রদানেরও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। মহামান্য হাইকোর্টের এই আদেশে দায়গ্রস্থ বাড়ির মালিককে ৬০ দিনের মধ্যে ব্যাংকের বকেয়া দেনা পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
গত ২০ ফেব্রæয়ারি বৃহস্পতিবার রিটটি শুনানীর সময় মহামান্য হাইকোর্ট নিলাম কার্যক্রম পরিচালনাকারী সরকারি রিসিভার অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ সুলতান আহম্মেদ মিঞাকে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে রিটের লিখিত জবাব দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আলোচিত ঐ অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ উচ্চ আদালতের আদেশ পালন করেননি। তিনি নিজে আদালতে অনুপস্থিত থাকলেও তার সহকারি আহসান হাবিব সর্বক্ষণ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতি এবং লিখিত জবাব ছাড়াই মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।

ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতের ৪/৯৯ নং মামলার সরকারি রিসিভার অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ সুলতান আহম্মেদ মিঞা এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ডেপুটি ম্যানেজার (বিজ্ঞাপন) আল-আমীন হাইকোর্টের নির্দেশে গত ২০ ফেব্রæয়ারি উল্লেখিত বেঞ্চে স্ব শরীরে উপস্থিত হন।এ দু’জনকে স্ব শরীরে হাইকোর্টে উপস্থিত হবার জন্য গত ১৯ জানুয়ারি প্রথম দফা এবং গত ৯ ফেব্রæয়ারি দ্বিতীয় দফায় উল্লেখিত বেঞ্চ আদেশ দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালত এই মামলার মুল নথি হাইকোর্টের উল্লেখিত বেঞ্চে প্রেরন করেন।
রিটের আরজিতে বলা হয়, আলোচিত এই ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানী ঢাকার ৩৬/২ কাকরাইলে। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক মেসার্স নিয়াজ গার্মেন্টস এর অনুকুলে ১৯৯৫ সালে ৩৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ঋণ প্রদান করে। এই ঋনের অনুকুলে কোম্পানী কাফরুল থানায় স্থাপিত কোম্পানির কারখানা ব্যাংকের অনুকুলে মটগেজ প্রদান করেন। পরবর্তীতে কোম্পানি রুগ্ন হয়ে যায়। ফলে সময় মত ঋন পরিশোধ না করায় ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের সুদাসল ৫৩ লাখ ২৩ হাজার টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ১৯৯৯ সালে কোম্পানির বন্দককৃত সম্পত্তি নিলাম করে টাকা আদায়ের চেষ্টা না, করে কোম্পানী ও তার পরিচালকদের দেউলিয়া ঘোষনা করাতে ঢাকার দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে ৪/৯৯ নং মামলা দায়ের করেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের মামলায় ঐ কোম্পানির ৪০% শেয়ার হোল্ডারধারী চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনের বসত বাড়ীটিই শুধু দেউলিয়া আদালতের “বি” তপশিলে দেখান। কিন্তু অন্য পরিচালকদের কোন সম্পত্তির বিবরণ দেননি। অবশেষে ২০০৮ সালে কোম্পানি ও তার ৪ জন পরিচালককে দেউলিয়া ঘোষনা করা হয়। আদালত কর্তৃক রোকসানা পারভীনের “বি” তপসিল বর্ণিত সম্পত্তি বিক্রয় করে ব্যাংকের টাকা আদায়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ সুলতান আহম্মেদ মিঞাকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়। রোকসানা পারভীনের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত মেজর, কাজী মাজেদুর রহমান ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর মারা যাওয়ার পর সরকারি রিসিভার অসহয় ঐ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের “বি” তপসিল বর্ণিত সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় করার জন্য ১৩ মে ২০১৫ তারিখের জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক খবর পত্রিকা আদালতে পেশ করেন। পেশকৃত ঐ দু’টি পত্রিকায় দরপত্র আহবানের নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ দেখানো হয়। অথচ উল্লেখিত দু’টি পত্রিকার বর্ণিত ১৩ মে ২০১৫ তারিখের প্রকাশিত মূল পত্রিকার কোন সংস্করণ ও কোন সংখ্যায় এ ধরনের কোন নিলাম দরপত্রের বিজ্ঞপ্তিই প্রকাশিত হয়নি। উপরন্ত এই জাল জালিয়াতির নিলামে ঐ আড়াই কাঠা সম্পত্তির উপরে থাকা ভবনের কথা গোপন করে কারসাজির মাধ্যমে ১৫ কোটি টাকার সম্পদ ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় নিলাম বিক্রয় আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। অতঃপর নিলাম গ্রহিতার অনুকুলে ঐ আড়াই কাঠা জমি হস্তান্তর বাবদ ঢাকা সাব রেজিঃ অফিসে ১৮১৩/১৬ নং দলিল সম্পাদন করা হয়। ঐ দলিলেও ৬ তলা ভবনের কথা গোপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঘোষিত দেউলিয়ার অব্যাহতি প্রাপ্ত সম্পত্তির আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রেও জালিয়াতি করা হয়। অতঃপর সরকারি রিসিভারের সহকারি জনৈক আহসান হাবিব ২২ জুন-২০১৭ তারিখে ঘটনাস্থলে নিজেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে পুলিশের সহায়তায় ভূয়া নিলামকৃত আড়াই কাঠা জমির দখল নিলাম গ্রহিতার অনুকুলে বুঝিয়ে দিতে এসে ৬ তলা ভবনসহ তপসিল বর্ণিত জমির দখল বুঝিয়ে দেন।

এই ঘটনায় রোকসানা পারভীন গত ২ মে ২০১৯ তারিখে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৫০৩৮/২০১৯ নং রিট দায়ের করলে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ৬ মে-২০১৯ তারিখে রুল জারি করেন। একই সঙ্গে দেউলিয়া আদালত কর্তৃক অনুমোদিত নিলামের কার্যক্রম স্থগিত আদেশ সহ বিবাদীদের বিরুদ্ধে নিষেধাঙ্গা জারি করেন।

Share