নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : মসলার প্যাকেটে করে হেরোইন বিক্রির সময় ধরা পড়া পারভীনের তথ্যে এই দফায় মো. আরিফের নাম পুলিশের খাতায় উঠেছে হেরোইন কারবারি হিসাবে। মোছা. পারভীনকে গ্রেপ্তার হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। খোঁজখবর নিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, এই আরিফই সেই আরিফ, মাত্র ২৪ বছর বয়সে যাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৭।
গত বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (লালবাগ) বিভাগ আরিফকে গ্রেপ্তারের খবর জানায়। ডিবির এই বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ বলেন, আরিফের বিরুদ্ধে এত মামলার দুটি কারণ। প্রথমত, তিনি অপরাধের সংস্পর্শে আসেন কৈশোরে। ধীরে ধীরে মাদক কারবারে হাত পাকান। দ্বিতীয়ত, তাঁর চক্রটি বেশ বড়। এই চক্রের অনেকেই বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হন। আর তাঁদের দেওয়া তথ্যে মামলায় আসামি হন আরিফ।
গ্রেপ্তারের পর গণমাধ্যমে ছাপা হওয়া আরিফের ছবির সঙ্গে নাটক–সিনেমায় দেখা ‘ড্রাগ লর্ড’দের কোনো মিল পাওয়া যায়না। মাঝারি উচ্চতার রোগা চেহারার এক তরুণ তিনি। ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকলে তাঁকে আলাদা করে চেনা যায় না। কিন্তু পুলিশের কাছে এই আরিফ ধূর্ত। যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুব কুশলী হওয়ায় আরিফ বারবার গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন। এ নিয়ে ২৭টি মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হলেন চারবার। জেলে থেকেছেন সর্বোচ্চ সাত মাস।
তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত। তিনি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা থেকে বড় মাদক কারবারিতে পরিণত হয়েছেন। পারভীন গ্রেপ্তারের পরই আরিফ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে জন্ম নেওয়া আরিফ ওয়েস্ট ধানমন্ডি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। বাবা মো. করিম একসময় লোহালক্কড়ের ব্যবসা করতেন। আরিফ যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন ব্যবসায় ধস নামে। স্কুলের বেতন, কোচিংয়ের ফি জমতে থাকে আরিফের। এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার চাইলে তিনি ‘ইয়াবা’ আনা–নেওয়ার কাজ দেন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ইয়াবার পোঁটলা নিয়ে আরেকজনের হাতে পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁর কাজ। এক পোঁটলা পৌঁছালে ৮০০ টাকা পেতেন আরিফ। সেই থেকে শুরু।
মোহাম্মদপুরে আরিফ ও তাঁর বন্ধুদের একটা বড় দল গড়ে উঠেছিল। সেই দলের এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার ভাইপো তাঁদের বিভিন্ন কাজে পাঠাতেন। বিশেষ করে জমিজমা দখলের কাজে। ওই সময় তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই আরিফ মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার পাম্প, কৃষি মার্কেট ও পাবনা হাউস গলিতে তিনটি ক্যারম বোর্ড বসিয়েছিলেন। সেখানে সারা দিন জুয়া খেলা হতো। ওই জুয়ার টাকা বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়েও হাতে থাকত আরিফের। একসময় বনিবনা না হওয়ায় ক্যারম বোর্ডগুলো তুলে দেন ওই রাজনৈতিক নেতার ভাইপো। এই সময় থেকে পুরোপুরি মাদক ব্যবসায় জড়ান আরিফ।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আরিফ প্রথম গ্রেপ্তার হন। সে সময় সাত মাস কারাগারে ছিলেন। পরিচিত সূত্রগুলো বলছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাঁকে ওই সময় রাখা হয়েছিল কারাগারে। ফিরে এসে এসএসসি পরীক্ষা দেন আরিফ। পাশাপাশি চলতে থাকে ইয়াবার কারবার। মোহাম্মদপুর কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন উচ্চমাধ্যমিকে। ২০১৫ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা আর তাঁর দেওয়া হয়নি। তৃতীয়বার তিনি গ্রেপ্তার হন বছরখানেক আগে। সে সময় সিদ্ধান্ত নেন, ইয়াবার কারবার আর করবেন না। এবার হেরোইনের কারবার শুরু করবেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ইয়াবার কারবার করার সময়ই তাঁর সঙ্গে টঙ্গি ব্রিজ এলাকার হেরোইন ব্যবসায়ী আলমের পরিচয় হয়। আরিফ তখন প্রতিদিন ২০০/৩০০ পুরিয়া এনে মোহাম্মদপুরে বিক্রি করতেন। গত বছর মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আবারও জেলে যান তিনি। কারাগারে তাঁর সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা মমিনুলের পরিচয় হয়। এরপর থেকে হেরোইনের কারবার বড় করেন তিনি। গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত নিয়মিত হেরোইন আনতেন সীমান্ত এলাকা থেকেই।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি ১০০ গ্রাম হেরোইন সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে কিনতেন। আর বিক্রি করতেন সাড়ে ৭ লাখ টাকায়। তখন মাসে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত মাদক কেনাবেচা করেছেন তিনি। তাঁর ৫০–৬০ জন বাঁধা ক্রেতা আছেন।
আরিফের পরিচিত এক সূত্র অবশ্য ২৪ বছরে ২৭ মামলার পেছনে আরও একটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এক র্যাব কর্মকর্তার সঙ্গে বিরোধের জেরে এত মামলা হয়েছে আরিফের বিরুদ্ধে। ওই কর্মকর্তার এক মাদক বিক্রেতা সোর্স (তথ্যদাতা) ছিলেন। আরিফের কারণে ওই সোর্সের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছিল। র্যাবের সেই কর্মকর্তা এখন পুলিশ সদরদপ্তরে আছেন। সে কারণে এক ২০১৮ সালেই ১৩টি মামলা হয় আরিফের নামে।
ওই সূত্র আরও জানায়, আরিফকে শুধু এলাকার প্রভাবশালী লোকজনই ব্যবহার করেননি, তাঁর আত্মীয়স্বজনেরাও ব্যবহার করেছেন। আরিফের মামা একসময় ঝুট ব্যবসা করতেন। মায়ের অনুরোধে আরিফ তাঁকে এই কারবারে আনেন। এখন তিনিও বড় কারবারি। তাঁর নামেও মাদকের একাধিক মামলা আছে। পুলিশ জেনেছে, মোহাম্মদপুরের সেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। খুব যে ভালো আছেন, তা নয়। কেউ দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করেন। কিন্তু পাঁচ–সাতজন আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তাঁরা মাদক কারবারেই রয়ে গেছেন।