বিশেষ প্রতিবেদক : কুইক রেন্টালে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২৯ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। বিদ্যুৎ সংকটকে পুঁজি করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এ লুটপাট করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব রেন্টাল-কুইকে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে। এজন্য ২০১০ সালে বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। শুরুতে তিন বছরের জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হলেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। এসব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ও বেশি। এর পরও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় অতি উচ্চ হারে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের আর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য স্থগিত করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়মুক্তির আইন। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তিগুলো পর্যালোচনা সংক্রান্ত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি এ নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেছে। জানা গেছে, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে—এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে চলেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি, বরং অলস বসে ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা।
পিডিবির তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ ২৯ হাজার কোটি টাকা পরিমোদ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে যে ১০টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে এগুলো হলো এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (পাঁচটি ইউনিট)। কেন্দ্রটি ৬ হাজার ৪১১ কোটি ২২ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছে। এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস নিয়েছে ২ হাজার ৩৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। কেপিসিএল (ইউনিট-২) নিয়েছে ১ হাজার ৯২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেড নিয়েছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (৮৫ মেগাওয়াট) নেয় ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ডাচ বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড নিয়েছে ১ হাজার ৫৩০ কোটি ৯ লাখ টাকা। অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস লিমিটেড নেয় ১ হাজার ৪৮৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস (৯৫ মেগাওয়াট) নিয়েছে ১ হাজার ৪৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। দেশ এনার্জি সিদ্ধিরগঞ্জ নিয়েছে ১ হাজার ৩৯১ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং ম্যাক্স পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছে ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০১১ সালের এপ্রিলে সামিটের মদনগঞ্জ কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসে। পাঁচ বছর মেয়াদি কেন্দ্রটির প্রথম দফায় মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। এই ১০ বছরে ৫ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা আয় করে কেন্দ্রটি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ। ২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি মার্চ পর্যন্ত ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে চলছে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২৭ কোটি টাকা আয় হয় এই কেন্দ্রের। ওরিয়নের সিদ্ধিরগঞ্জ কেন্দ্র ১২ বছর ধরে ব্যবসা করছে। ২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত আয় হয়েছে ৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। গ্রুপটির মেঘনাঘাট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আয় করেছে ৬ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। কেপিসিএলের খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট ২০২২-২৩ পর্যন্ত ১৩ বছরে আয় করেছে ৬ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। কেপিসিএলের নোয়াপাড়ার কেন্দ্রটির গত অর্থবছর পর্যন্ত আয় ২ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। সিনহা গ্রুপের কেন্দ্রের আয় গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছর পর্যন্ত পাওয়ার প্যাকের কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রের আয় ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রের মেয়াদ রয়েছে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত। ভেঞ্চার গ্রুপের ভোলা কেন্দ্রের আয় গত অর্থবছর পর্যন্ত ৮৮২ কোটি টাকা। ২০১২ সালে উৎপাদনে আসা এই কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ তিন দফা বেড়েছে। বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুলাইয়ে। এনার্জি প্রিমার ফেঞ্চুগঞ্জ কেন্দ্রের আয় ২০২২-২৩ পর্যন্ত এক হাজার ৬৫ কোটি টাকা।