ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : সময় ও স্বার্থ যে সম্পর্ক বদলে দেয়, তার একটি উদাহরণ হতে পারে আফগানিস্তানের সশস্ত্র সংগঠন তালেবান ও রাশিয়ার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আবার আবর্তিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ‍দুটি দেশ যে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, তার অনেক উদাহরণই আছে। তবে এই বৈরী সম্পর্কের মধ্যেও দুই দেশ যে বিষয়ে আপাত একমত ছিল, তা হলো সন্ত্রাসবাদ দমন। যদিও এই সন্ত্রাসের সংজ্ঞা ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে। যে তালেবান সন্ত্রাসী ছিল, সেই তালেবান এখন বন্ধু হয়ে উঠছে। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে ৯/১১ হামলার পরবর্তী ঘটনাবলিতে।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালে সন্ত্রাসী হামলার পরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে প্রথম যিনি টেলিফোন করেছিলেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সিএনএন বলছে, সেদিন বুশের সঙ্গে কথা বলার পর টেলিভিশন ভাষণে পুতিন বলেছিলেন, সন্ত্রাসের অর্থ কী, রাশিয়া তা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তিনি এ–ও বলেছিলেন, ‘অন্য যে কারও চেয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কষ্ট সবচেয়ে বেশি বুঝি। আমি বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পাশে আমরা আছি।’

এরপর অবশ্য অন্য তথ্য বেরিয়ে আসে। ৯/১১ হামলার কয়েক মাস পর পুতিন বলেছিলেন, হামলা হতে পারে সেই তথ্য তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার দেওয়া এই তথ্য যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু আমলে নিয়েছিল, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, এমন তথ্য আমলে নিলে ৯/১১-এর মতো ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটত কি না, তা নিয়ে দ্বিধা থেকে যায়। কিন্তু সেই আগের কথাতেই ফিরতে হয় যে দুই দেশ একে অপরকে কতটুকু বিশ্বাস করে?

যাহোক, ৯/১১–এর সেই সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, তাঁর দেশ গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবে। আল-জাজিরা বলছে, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে আকাশসীমাও ব্যবহার করতে দিয়েছিল রাশিয়া। এমনকি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই দেশ উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তানে মার্কিন ও পশ্চিমা দেশগুলোর জোট ন্যাটোর সেনা মেতায়েনের অনুমোদনও দিয়েছিল মস্কো।

শুধু সন্ত্রাসবাদ দমনই রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল এমনটা ভাবার কারণ নেই। হ্যাঁ, এটা সত্য যে রাশিয়াকেও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে হয়েছে। ৯/১১ হামলার দুই বছর আগে রাশিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এ ছাড়া তালেবানের সাবেক নেতা মোল্লা ওমর চেচনিয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং রাশিয়ার চোখে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী, সেই চেচেনদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল আফগানিস্তানে। আর এই চেচেনরা পরে রাশিয়ায় ‘জিহাদের’ ডাক দিয়েছিল। ফলে তালেবান দমনে রাশিয়ার যে স্বার্থ ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এ ছাড়া ১৯৭৮ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছর আফগানিস্তানের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যে যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় আসেনি। কোনো বিজয়ের ঘোষণা ছাড়া সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে সেনা সরিয়ে নিতে হয়েছিল। আর এই যুদ্ধে সামগ্রিক জয় পেয়েছিল তালেবানের পূর্বসূরি আফগান মুজাহিদিনরা। অর্থাৎ তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার বৈরিতা নতুন নয়।

আফগানিস্তানে ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে যুদ্ধ চলেছে, তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও খানিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৯৭৮ সালে আফগানিস্তান ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি ‍চুক্তি হয়েছিল। এই ‍চুক্তি অনুসারে দুই পক্ষ পরস্পরকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করবে। ওই সময় আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিলেন নুর মোহাম্মদ তারাকি।

মূলত ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানের মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে বামপন্থী সামরিক কর্মকর্তা তারাকির বাহিনী। এরপর ক্ষমতা ভাগাভাগি হয় মার্ক্স ও লেনিনপন্থী দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে। এই দুটি দল হলো পিপলস পার্টি ও ব্যানার পার্টি। দুটি দল মিলে হয়ে যায় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, যারা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তার ওপর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদ ছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালে দলের মধ্যে তারাকিবিরোধীরা তাঁকে হত্যা করে এবং ক্ষমতা দখল করে। ফলে সোভিয়েত তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ১৯৭৮ সালের সেই চুক্তি অনুসারে হামলা চালায়। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে হামলা চালায় সোভিয়েত। এই হামলার তিন দিনের মাথায় ২৭ ডিসেম্বর কাবুলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সোভিয়েতের হাতে। এরপর পিপলস পার্টির নেতা হাফিজুল্লাহ আমিনকে সরিয়ে ব্যানার পার্টির নেতা বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় বসানো হয়। কিন্তু সেই সময় আসলে এই কমিউনিস্ট নেতারা কেউই জনপ্রিয় ছিলেন না। আর সেই সুযোগটাই নেয় মুজাহিদিনরা। তারা নতুন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

মুজাহিদিন যেমন সুযোগ নিয়েছিল, তাদের ওপর ভর করে মধ্য এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮০ সাল নাগাদ এই দৃশ্যপটে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র। স্কাই নিউজ বলছে, সোভিয়েতের সঙ্গে লড়াইয়ে মুজাহিদিনদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এরপর ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে। ওই বছরই দেশটিতে নির্বাচন দেওয়া হয়। সোভিয়েতের মদদে ক্ষমতায় বসেন মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত তার সব সেনাকে ফিরিয়ে নেয়। ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনার প্রাণ যায় এই যুদ্ধে। আর প্রাণ হারায় কয়েক লাখ আফগান।

সোভিয়েতের বিদায় আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ কাছাকাছি সময়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে নিয়ন্ত্রণ আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, সেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল মুজাহিদিনরা। কিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মুজাহিদিনরা ক্ষমতাচ্যুত হয়। ক্ষমতার কেন্দ্র চলে আসে তালেবান। যদিও এই তালেবানের জন্ম মুজাহিদিনের একাংশ থেকেই।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানের সীমান্তঘেঁষা এলাকা থেকে তালেবানের যাত্রা শুরু। এটা ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। ওই সময় তাদের অর্থায়ন করত সৌদি আরব।

অর্থাৎ ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যে তালেবানের ওপর হামলা চালানো হয়, সেই তালেবান আসলে রাশিয়ারও মিত্র না, যুক্তরাষ্ট্রেরও মিত্র না। ফলে সেই সময় সন্ত্রাস দমন ইস্যুতে মার্কিন-রুশ ঐকমত্যে পৌঁছানো ছিল খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। কিন্তু পরিস্থিতি তো বদলাতে সময় লাগে না।

২০০১ সাল নাগাদ রাশিয়ার জন্য গলার কাঁটা ছিল আফগানিস্তানে চাষ হওয়া পপি ও উৎপাদিত হেরোইন। আল-জাজিরা বলছে, এই মাদক চাষ এবং তা প্রক্রিয়াজাতের ওপর ন্যাটো বাহিনী কোনো নজরই রাখেনি। ফলে রাশিয়া তার অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। কড়া ভাষায় ন্যাটোর সমালোচনা করে রুশ কর্তৃপক্ষ।

এরপর ২০০১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত চলল ‘সন্ত্রাস দমনের’ যুদ্ধ। মার্কিন ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ শেষ যখন হলো, তখন তালেবান ইস্যুতে যেন সব দেশেরই অবস্থান বদলাতে শুরু করল। তালেবানকে কে স্বীকৃতি দেবে, সেটা নিয়ে কানাঘুষা চললেও তাদের সঙ্গে কাজ করতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব, চীন, রাশিয়াও।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের জন্য একটি সমাধান বের করতে আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থাকবে। প্রয়োজন হলে অবশ্যই তালেবানের সঙ্গেও আমরা কাজ করব।’

বার্তা সংস্থা এএফপির খবর, মার্কিন সেনাদের সর্বোচ্চ পদধারী জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান মার্ক মিলি ইঙ্গিত দিয়েছেন, জঙ্গি দমনে ভবিষ্যতে তালেবানের সঙ্গে কাজ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। আর চীন সরকার ইতিমধ্যে তালেবানকে সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে।

বসে নেই রাশিয়াও। দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস আগে তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দিত। তারা এখন লিখছে তালেবান ‘উগ্রবাদী সংগঠন’। যদিও রাশিয়া সরকারের তালিকায় এখনো তালেবান একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু কূটনৈতিক তৎপরতা থেমে নেই। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিশেষ দূত জামির কাবুলভ বলেছেন, সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পুতুল’ সরকারের প্রধান। আর তাঁর সঙ্গে সমঝোতার চেয়ে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা অনেক সহজ।

পশ্চিমা বিশ্ব যখন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে নিজেদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করেছে, তখন রাশিয়া সময় নিয়েছে। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্ব যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তখন আফগানিস্তানে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি ঝিরনোভ সেখানকার পরিস্থিতিকে নিরাপদ বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ১৫ আগস্ট কাবুল পতনের পর ২৫ আগস্ট তিনি আফগানিস্তানে বিনিয়োগে রাশিয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া তার অবস্থান ধরে রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব, সেটা এখন দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, রাশিয়া ছাড়াও আঞ্চলিক শক্তি ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো তৎপরতা শুরু করেছে। চীন ও ভারত আলোচনা করেছে তালেবানের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় কথা হলো তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে ক্ষমতায় এসেছে। ফলে কোন দেশ তালেবানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর এর জের ধরে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেবে, সেটা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।

Share