খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তনে সংকটে পড়বে ব্যাংক খাত, চাপ বাড়বে অর্থনীতিতে

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে এবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নিয়ম কার্যকর হলে অনাদায়ী ঋণখেলাপি করার মেয়াদ প্রায় সব ক্ষেত্রেই ৩ মাস করে কমে আসবে। এতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া ব্যবসায়ীরা চাপে পড়বেন। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতেও খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। আর খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রত্যেকটি ব্যাংককে বেশি হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এতে চাপে পড়বে ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি পুরো অর্থনীতি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে চলমান ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের নীতিমালা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে সব খেলাপি ঋণের মেয়াদ তিন মাস কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে যেসব ঋণ কিস্তি পরিশোধের ছয় মাস থেকে ৯ মাসের মধ্যে খেলাপি হচ্ছে সেগুলো তিন মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করা হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ২০১৯ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করলেও এরপর থেকে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর ফলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়। এতে ঋণখেলাপিরা খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখার সুযোগ পান।

নতুন নিয়ম কার্যকর হলে আড়াল করার প্রবণতা কমবে বলে মনে করা হলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংক খাতে সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তবে এ সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল নিজ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে আইএমএফের পরামর্শে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতকে সঠিক পথে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলে বিদেশে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের হিসাবের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এতে খেলাপি ঋণ বাড়বে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি উল্লেখ করেন, আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানোর শর্তও আরোপ করেছে। খেলাপি কমাতে হলে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। ঋণ বিতরণ বাড়িয়ে খেলাপি ঋণের হার কমানো যৌক্তিক হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপের ফলে বিপদে পড়বেন তারা। কারণ, ব্যবসায়ীরা যখন এলসি বা ঋণপত্র খুলেছেন, তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। এখন সেই একই এলসি ১০৮ টাকা প্রতি ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এমনিতেই চাপে পড়েছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী বলেন, ওভারডিউ ঋণ শ্রেণিকরণের সময় ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হলে একদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। অন্যদিকে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পদক্ষেপ নিলে হুমকিতে পড়বে বেসরকারি খাত। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শ্রেণিকরণের সময় ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের চাপে ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণের নীতিমালা ব্যাপকভাবে শিথিল করা হয়। ওই সময় বলা হয়, মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল। এ কারণে ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, মেয়াদি ঋণের গ্রাহকরা একাধারে ছয় মাস ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপি করা যাবে না। আর চলমান ঋণের ক্ষেত্রে একাধারে তিন মাস ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি করা যাবে না। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ছয় মাসের পর থেকে পরবর্তী তিন মাস অর্থাৎ ৯ মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণের নিম্ন স্তর অর্থাৎ সাবস্ট্যান্ডার্ড থাকবে। ৯ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ হবে। একাধারে ১২ মাস কিস্তি পরিশোধ না করলে তারপর পর থেকে সেটা মন্দ মানের খেলাপি ঋণ হবে। অপর দিকে চলমানের ক্ষেত্রে একাধারে ঋণের কিস্তি তিন মাস থেকে ৯ মাস পর্যন্ত পরিশোধ না করলে সেটা নিম্নমানের খেলাপি ঋণ হবে। ৯ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের বেশি হলে সেটা মন্দ মানের খেলাপি ঋণ হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সার্কুলার জারির পর ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ হঠাৎ কমে যায়। ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ রাখার বাধ্যবাধকতাও কমে যায়। এই নীতিমালার ফলে ব্যবসায়ী মহল ও ব্যাংক উভয়ই চাপমুক্ত হয়। এছাড়া কোভিডের কারণে ২০২০ সালে ব্যবসায়ীরা কোনও ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে তারা খেলাপি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ২০২২ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধের এই বিশেষ ছাড় তুলে নিলেও এ সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা কার্যক্রমের অস্বাভাবিক ক্ষতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ পরিশোধে ছাড়ের আবেদন জানান।

ব্যবসায়ীদের ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প ঋণ, কৃষি ঋণ ও সিএমএসএমই ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এই সুবিধা তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র তিন মাসের জন্য সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারে। ফের ব্যবসায়ীদের একই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সব চলতি মূলধন ও মেয়াদি ঋণের ৫০ শতাংশ পরিশোধে খেলাপি হবে না বলে বিশেষ ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এত সুবিধা দেওয়ার পরও চলতি বছর প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায়, যা মোট বকেয়া ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও আইএমএফ মনে করে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশে ঋণের পরিমাণ আরও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বাংলাদেশে না থাকায় আইএমএফ আপত্তি করেছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা।

জানা গেছে, আগামী নভেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করার কথা রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ঋণের অর্থ ছাড় করার আগে আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশে আসবে আগামী অক্টোবরে। তারা শর্তের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করা হবে।

এ কারণে আইএমএফের মিশন আসার আগেই তাদের শর্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংকাররা খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছেন। তারা বলেছেন, আইএমএফের চাপে সংজ্ঞা পরিবর্তন করলে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আইএমএফের শর্তানুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন পদক্ষেপ নিলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে যাবে। তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এরমধ্যে তিন মাস পর ঋণখেলাপি করা হলে খেলাপির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে, প্রভিশন রাখতে সমস্যা হবে, ব্যাংকের আয়ও কমে যাবে।

Share