হাসান নিটোল : চার বছর আগে, ২০১৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনের আলোচনায়-প্রচারণায় এগিয়ে ছিলেন হেভিওয়েট ও প্রভাবশালী নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনিই হতে যাচ্ছেন আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। এই ভাবনার পেছনে অনেকগুলো শক্তিশালী কারণও ছিল। হিলারি বংশগতভাবে আমেরিকান, উঁচু ঘরের মেয়ে। তিনি মেধাবী ছিলেন, পড়েছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারপর আবার আমেরিকার জনপ্রিয় সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সহধর্মিণীও তিনি। ছিলেন ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জনপ্রিয় ডেমোক্র্যাট সিনেটর। আবার, বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ফার্স্ট লেডি হিসেবে থেকে এবং ওবামা প্রশাসনে কাজ করে নিজেকে তৈরি করেছেন একজন যোগ্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে। ডেমোক্রেটিক পার্টিও সেবার হিলারিকেই বেছে নিয়েছিলেন। আর জরিপের ফলাফল তো তার পক্ষে ছিলই। কিন্তু এতকিছুর পরও হিলারি নির্বাচনে হেরে গেলেন। তখন অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হয়তো চায় না তাদের প্রেসিডেন্ট হোক কোনো একজন নারী। আর আমেরিকায় একজন নারী বোধহয় কখনোই প্রেসিডেন্ট হবেন না।
আর ভাববোই না কেন? তিনি যে সেই নারী নন, তিনি হিলারি ক্লিনটন। তার পরও হেরে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে; তাহলে আর কেইবা পারবে?
ঠিক চার বছর পর, এবার আসি ২০২০ সালের এবারের নির্বাচনে। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী কমলা হ্যারিসের দিকে একটু তাকাই। কমলা কিন্তু হিলারির মতো অত পরিচিত নন বিশ্বব্যাপী, তেমনি হেভিওয়েটও নন। তার নেই ফ্যামিলি কিংবা বংশের জোর। কমলার বাবা-মা জন্মগতভাবে আমেরিকান নন। কমলা তার বাবা-মায়ের মতোই ছিলেন মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা, ছিলেন দক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেল। এক মেয়াদে ক্যালিফোর্নিয়র গভর্নরের দায়িত্ব পালন করে কমলা কিছুটা পরিচিতি পেয়েছেন। হিলারির তুলনায় তার প্রোফাইল দুর্বলই বলা চলে। ২০২০ নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন পেতে জো বাইডেনের বিপক্ষে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু দল এবার তাকে বিবেচনা করেনি, মনোনয়ন দেয়নি। দিয়েছে জো বাইডেনকে।
অথচ জো বাইডেন একটি সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তার রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন কমলা হ্যারিসকে। কমলার বাবা-মা আমেরিকান নন বলে বাইডেনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘরে-বাইরে ছিল ব্যাপক গুঞ্জন। তাদের প্রতিপক্ষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘কমলা আমেরিকার বৈধ নাগরিক নন। কমলার জন্ম আমেরিকায় হয়নি, সে অভিবাসী।’ বাইডেন যে কমলাকে বেছে নিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, তার প্রমাণ মিলেছে হাতেনাতে। আগ্রাসী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনেকটাই ম্রিয়মাণ ছিলেন বাইডেন। প্রতিতুলনায়, কমলার ক্ষুরধার বক্তব্য আর উজ্জ্বল উপস্থিতি সেই শূন্যতা পূরণ করে দিয়েছে। নির্বাচনে বিজয় তার প্রমাণ।
এখন আমরা উন্নত রাষ্ট্র আমেরিকা ফেলে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ ভারতের দিকে তাকাই। এবার, নির্বাচন হয়েছে আমেরিকায় অথচ এই নির্বাচন নিয়ে রাতদিন প্রার্থনা হয়েছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। ভারতের তামিলনাড়ুর একটি গ্রামে, নাম থুলাসেন্থিরাপুরম। আমেরিকা থেকে গ্রামটির দূরত্ব আট হাজার মাইলের কিছু বেশি হলেও নির্বাচনী আমেজ সেই গ্রামে কম ছিল না। আর এই আমেজই হয়ে উঠেছে বড় খবর, প্রচার পেয়েছে বিশ্ব মিডিয়ায়। মিডিয়া লিখেছে তামিলনাড়ুর গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী আমেজ।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মায়ের বাড়ি ভারতের তামিলনাড়ুর থুলাসেন্থিরাপুরম গ্রামে। প্রায় সাত দশক আগে, কমলার মা শ্যামলা গোলাপান এই গ্রাম থেকেই পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকায়। কমলার মেধাবী মা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউসি বারক্লে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর সেখানেই ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম হয় কমলা হ্যারিসের। তাই চেন্নাইয়ের থুলাসেন্থিরাপুরম গ্রামটি কমলার নানাবাড়ি। সেখানে কমলার সম্পর্কীয় নানা ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী পিভি গোপালান আয়োজন করেন নির্বাচন নিয়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে কমলার সফলতা কামনা করে একটি পোস্টারে তামিল ভাষায় লেখা ছিল, ‘থুলাসেন্থিরাপুরম থেকে আমেরিকা’।
এই একটি লাইনেই লুকিয়ে আছে কমলার অভিবাসী মায়ের সংগ্রামী জীবনের আত্মকথা। কমলার বয়স যখন সাত বছর তখন তার বাবা-মা আলাদা হয়ে যান। দুই মেয়েকে নিয়ে একাই জীবনযুদ্ধ করেছেন মা শ্যামলা। ষাটের দশকের কথা। আমেরিকা জুড়ে বর্ণবাদ জেঁকে বসেছিল। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনও তখন তুঙ্গে। আমেরিকায় বর্ণবাদ শত শত বছরের পুরোনো সমস্যা। সাদা মানুষেরা কালোদের মানুষ বলে মর্যাদা দিতে চায় না। কালো মানুষ ছিল বঞ্চিত, নিগৃহীত অত্যাচারিত। কমলা তার আত্মকথায় লিখেছেন, তার মা জানতেন- আমেরিকার সমাজে তার কালো মেয়েকে কতটা বিরূপ পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে বড় হতে হবে। আর তাই, মা শ্যামলা তাদের দুই বোনকে সংগ্রামী জীবনের দীক্ষা দিয়ে গেছেন। শ্যামলা মারা গেছেন ২০০৯ সালে, মেয়ের বিজয় দেখে যেতে পারেননি। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন কমলা। সেখানে মাকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তিনি (কমলার মা) যখন ১৯ বছর বয়সে ভারত থেকে এখানে (আমেরিকায়) এসেছিলেন, তখন তিনি সম্ভবত এ মুহূর্তটির কথা খুব একটা কল্পনাও করেননি। তবে তিনি এমন এক আমেরিকায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে এ ধরনের মুহূর্ত ঘটা সম্ভব। ‘কমলার কথায় বোঝা যায়, তার মা কখনও চিন্তাই করেননি মেয়ে আমেরিকায় অত বড় একটি জায়গা করে নেবেন। কমলা তার মায়ের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
জো বাইডেনের বয়স এখন ৭৭ বছর। অনেকেই মনে করছেন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট নিজের মেয়াদ শেষ করে আবার নির্বাচন করতে পারবেন কিনা; সে বিষয়ে যথেষ্ট ‘কিন্তু’ রয়েছে। আর তাই যদি হয় তবে আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্র্যাট দল থেকে মনোনয়ন পাবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে কমলার। সেক্ষেত্রে ৫৬ বছর বয়সী কমলা নিজেকে প্রস্তুত করতে এবং গুছিয়ে নিতে অনেক সময়ও হাতে পাবেন।
ফলে আমার মতো মানুষ যারা হিলারি হেরে যাওয়ার পর আর কোনো নারী প্রেসিডেন্টের সম্ভাবনা দেখছিলেন না আমেরিকায়, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তাদের মনের দৃশ্যপট আমূল পাল্টে গেছে। হেভিওয়েট বিখ্যাত সাদা হিলারি পারেননি; কিন্তু অখ্যাত কালো কমলার সম্ভাবনা এখনও মিইয়ে যায়নি। এটাই গণতন্ত্র। এখানেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কমলার ভাইস প্রেসিডেন্ট জয়ে মার্কিন নারীদের রাজনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল। এক্ষেত্রে হিলারিও একটি ধন্যবাদ পেতে পারেন, কারণ প্রথা ভেঙে নারীদের জন্য দুয়ারটা তিনিই প্রথম খুলে দিয়েছেন।
গণতন্ত্রের চমক এবার আমরা দেখলাম আমেরিকায়। যেখানে নাগরিকের ভোটই শেষ কথা। গণতন্ত্র অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। গণতন্ত্র কালোকে করে বিজয়ী ও অহংকারী, সাদাকে করে পরাজিত। জয়ী জো বাইডেন তার ভাষণে বলেছেন, ‘ডোন্ট স্য ইট ইজ নট পসিবল ইন আমেরিকা।’ আসলেই তাই। বহু জাতি-বর্ণ-গোত্রের সম্মিলনে গড়ে ওঠা বৈচিত্রময় একটি দেশ আমেরিকা। এত বিভিন্নতা, এত বৈচিত্র্য অথচ গণতন্ত্রই তাদের এক আমেরিকান করে তোলে। তাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। অসম্ভবকে করে সম্ভব। একজন কমলা হ্যারিসের উত্থান আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকেই ফুটিয়ে তোলে। সেই কথাটাই কমলা আরও সুন্দরভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমিই প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কিন্তু শেষ নই।