গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল

নয়াবার্তা প্রতিনিধি : ঋণখেলাপি হওয়ায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এই সিদ্ধান্তকে পক্ষপাতমূলক আখ্যা দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।

আজ রোববার সকালে গাজীপুর শহরের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে স্থাপিত সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই শেষে জাহাঙ্গীর আলমসহ তিন মেয়র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান ও জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনসহ ৯ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়।

মনোনয়নপত্র যাচাইয়ের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণার পর তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। ব্যাংকের পাওনার ইনস্টলমেন্ট (কিস্তি) জমা দেওয়ার কথা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লিখিত ও মৌখিক জবানবন্দি দিয়েছে। তারপরও আপনারা যে কাজটি করলেন, তাতে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে।’

জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের যে নিরপেক্ষতা ছিল, তারা সেই নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছে। তারা কোন অদৃশ্য শক্তির চাপে সরে গেছে, আমি জানি না, তবে আমি ন্যায়বিচার চাই। আমি আপিল করব। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টে যাব। আমি সবশেষ লড়ে যাব। আমি দেশবাসীর কাছে জানতে চাই, একজন প্রার্থী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে ন্যায়বিচার পাব কি না।’

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরে নিউ টাউন সিটি ওয়্যার নামের একটি কোরিয়ান কোম্পানি অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেখানে গ্যারান্টার বা জামিনদার হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) সেই ঋণের তথ্য দেয়। সেখানে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়। এরপর সেই তথ্যের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

ঋণের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম রিটার্নিং কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় কোরিয়ান মালিকানাধীন একটি কম্পোজিট কারখানা রয়েছে। সেই কোম্পানিতে একসময় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। মালিকপক্ষ বেতন দিতে পারে না। ওই কোম্পানির মধ্যে তাঁর কোনো শেয়ার নেই। কোনো লভ্যাংশও পান না। তবুও হাজার হাজার শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে তিনি নিজের সম্পদ দিয়েছেন। ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে সেই কোরিয়ান মালিক ঋণ নিয়ে কারখানাটি চলমান রেখেছেন। তিনি ঋণের জামিনদার মাত্র। করোনা মহামারির কারণে কোরিয়ানরা ব্যাংকে যথাসময়ে ওই ঋণের কিস্তি দিতে পারেনি।

নিজের ও মায়ের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে
নিজের ও মায়ের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকেছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি প্রার্থী হওয়ার পর ১১ ও ১৮ এপ্রিল কোরিয়ানরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের যে পাওনা ছিল, তা পরিশোধ করেছে। কোরিয়ান কোম্পানি ১৭ এপ্রিল অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করেছে। সেসব কাগজপত্র আইনজীবী ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়েছে। তারপরও আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।’

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে একজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। তিনিও মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে রিটার্নিং কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, আইন অনুযায়ী গ্যারান্টার কখনো ঋণখেলাপি হয় না। এ–সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায় আছে। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যে যেহেতু ব্যাংক টাকা পেয়ে গেছে এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো আপত্তি করছে না, সেহেতু তিনি ঋণখেলাপি নন।

পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী জাহাঙ্গীর আলম ঋণখেলাপি। তবে জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেছেন, তিনি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেছেন। এ–সংক্রান্ত কাগজও তিনি দাখিল করেছেন। কিন্তু ব্যাংক যে এটি গ্রহণ করেছে, তা যথাযথ মনে হয়নি। তাই তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলো। নির্বাচন কমিশনে এ বিষয়ে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। তাই তাঁকে আপিল করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ফরিদুল ইসলাম বলেন, মেয়র পদে ১২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। ৩০০ জন সমর্থনকারীর স্বাক্ষরবিহীন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী অলিউর রহমান ও যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।

যাচাই-বাছাই শেষে মেয়র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান, জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন, গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, স্বতন্ত্র আবদুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, হারুন অর রশিদ, সরকার শাহানুর ইসলাম ও জায়েদা খাতুন এবং জাকের পার্টির রাজু আহমেদের মনোনয়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাময়িক বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তবে দল মনোনয়ন দিয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে। ১৫ এপ্রিল বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই গুঞ্জন চলছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন জাহাঙ্গীর। সেই গুঞ্জন সত্যি করে গত বুধবার মেয়র পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর হয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তাঁর প্রতিনিধি। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের নামেও মেয়র পদের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়।

এরপর গত বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন জাহাঙ্গীর আলম। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নৌকার বিরুদ্ধে নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।

Share