নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : ‘আগামীকাল সকালে মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা এলাকার ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হবে। আপনারা সবাই ভোরে সেখানে চলে আসুন। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ান।’ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে এভাবেই মাইকিং করা হয়েছিল কয়রা উপজেলা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নে। ক্ষণিকের এই মাইকিংয়েই সাড়া দিয়ে আজ শুক্রবার ভোর থেকেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন ভাঙা ওই বাঁধের স্থানে। ততক্ষণে ভাটার টান ধরেছে শাকবাড়িয়া নদীতে।
মাইক হাতে একজন আহ্বান জানালেন সবাইকে কাজে নেমে পড়ার জন্য। এরপরই শুরু হলো পবনা এলাকার ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের সংগ্রাম। কেউ বস্তায় মাটি ভরছেন আবার কেউ মাটির ওই বস্তা নিয়ে ফেলছেন ভাঙা বাঁধের স্থানে। কেউবা ব্যস্ত বাঁধ ও খুঁটি পোঁতার কাজে। বসে ছিলেন না নারীরাও। ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত মানুষকে পানি খাইয়ে, এটা–ওটা এনে দিয়ে কাজ করছিলেন তাঁরাও। এভাবে প্রায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত টানা কাজ চলার পর জোয়ারের পানি আসার আগেই বাঁধ মেরামত করে ফেলতে সক্ষম হন এলাকাবাসী। এ কাজে যুক্ত হয়েছিলেন প্রায় ২ হাজার মানুষ।
বাঁধ বাঁধার এ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে উপকূলীয় এলাকায়। ভেঙে যাওয়া বাঁধ বেঁধে দেওয়াকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘চাপান’। এই চাপানকাজে যাঁরা অংশ নেন, তাঁরা জানেন এর বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পাবেন না। তারপরও একে অপরের সহায়তায় হাতে হাত রেখে কাজ করেন তাঁরা।
নদীভাঙনের ফলে প্রায় ৮ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ৫ হাজার বিঘার মতো মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে।
পবনা এলাকার ওই বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল গত বুধবার জোয়ারে। এতে মহারাজপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড পুরোপুরি এবং ১ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আংশিক সাগরের নোনা পানিতে তলিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেও পারেননি এলাকাবাসী। এ কারণে শুক্রবার অধিক সংখ্যক মানুষকে নিয়ে কাজ শুরু করেন তাঁরা। ভাঙা স্থানে বালু ও মাটিভর্তি ১০ হাজার বস্তা ফেলা হয়েছে।
এ ছাড়া আজ দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধও মেরামত করা হয়েছে। ওই কাজেও দুই হাজারের মতো মানুষ অংশ নেন। এলাকাবাসী বলেন, ভেঙে যাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব বাঁধ মেরামত করতে হয়। আর তা নাহলে একদিকে যেমন পানির তোড়ে ভাঙন এলাকা গভীর হতে থাকে, অন্যদিকে প্রতিদিনই জোয়ারের পানি প্লাবিত করে নতুন নতুন এলাকা। ভাঙন এলাকা একবার গভীর হয়ে গেলে সেখানে বাঁধ দেওয়া কঠিন।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন এই বাঁধ মেরামতের কাজে নেমেছিলেন। তিনি বলেন, হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে ভাঙা বাঁধ মেরামতের কাজ বহু আগে থেকেই চলে আসছে। রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত, যত বড় বিরোধই থাকুক না কেন, এই কাজে কেউ পিছপা হন না। এটা জন্ম থেকে কয়রা এলাকার মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গত বুধ ও গতকাল বৃহস্পতিবার উচ্চ জোয়ারে কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে অন্তত ১০টি স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে প্লাবিত হয় প্রায় অর্ধশত গ্রাম। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মহারাজপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের দশালিয়া ও হোগলা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে গোবিন্দপুর, দিয়াড়া, দশালিয়া, মহারাজপুরসহ অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাগালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মধ্যেও পানি ঢুকে পড়েছে।
ওই ইউনিয়নের মঠবাড়ি ও পবনা এলাকার বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ইউনিয়নটির প্রায় সব গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। বুধবার রাতে কাজ করে মঠবাড়ি এলাকার বাঁধ মেরামত করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। আর আজ পবনা এলাকার বাঁধ মেরামত করা হলো। পবনা এলাকার ভাঙা স্থান দিয়ে আসা পানি সদর ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে এসেছিল।
মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জি এম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, নদীভাঙনের ফলে প্রায় ৮ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ৫ হাজার বিঘার মতো মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঁধ মেরামতে বস্তা ও বাঁশ-খুঁটি দিয়ে সহায়তা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কাল শনিবার থেকে দশালিয়া ও হোগলা এলাকার বাঁধ মেরামতের কাজ চলবে। ওই এলাকায় মাটিস্বল্পতার কারণে বাঁধ মেরামতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউপির চেয়ারম্যান জি এম শামসুর রহমান বলেন, ইয়াসের প্রভাবে ইউনিয়নের গোলখালী ও আংটিহারা এলাকায় শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। বুধবার সকালেই এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে গোলখালীর বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়। বুধবার দুপুরে ভেঙে যায় আংটিহারা এলাকার বাঁধ। ওই দিন রাতে বাঁধ মেরামত করে রাতের পানি লোকালয়ে প্রবেশ বন্ধ করা গেলেও বৃহস্পতিবার দুপুরের জোয়ারে আবার তা ভেঙে যায়। তবে শুক্রবার ভোর থেকে কাজ করে ওই জায়গায়ও পানি বন্ধ করা গেছে। এখন অধিকাংশ এলাকা পানিমুক্ত। তবে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাতির ঘেরি এলাকার ভাঙনে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বীণাপাণি ও হলুদবুনিয়া গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত, যত বড় বিরোধই থাকুক না কেন, বড় দুর্যোগে বাঁধ মেরামতের আহ্বানে পিছপা হন না কেউই। খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি এলাকায়, ২৮ মেছবি: সাদ্দাম হোসেন
মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া ও হোগলা এবং উত্তর বেদকাশীর গাতির ঘেরি এলাকায় বাঁধ দিতে পারলে অনেকটা শঙ্কামুক্ত হবে কয়রাবাসী। ওই দুই স্থান এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বৃহস্পতিবার দুপুরের চেয়ে শুক্রবার দুপুরে নদ-নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা প্রায় দেড় ফুট কম ছিল। এ কারণে আর বাঁধ ভাঙার ভয় নেই বলে মনে করছেন পাউবোর কর্মকর্তারা।
কয়রা উপজেলাটি পড়েছে পাউবোর সাতক্ষীরা অঞ্চলের বিভাগ-২-এর আওতায়। ওই বিভাগের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান বলেন, স্থানীয় জনগণের সহায়তায় কয়রার কয়েকটি এলাকায় বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়েছে। ওই কাজে বস্তা, বাঁশ-খুঁটি দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকার বাঁধের কাজ করা হবে।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রা ইউনিয়নে চলছে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের কাজ। বড় কোনো দুর্যোগ এলেই স্বেচ্ছাশ্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষ। তবে কয়রাবাসীকে বাঁচাতে টেকসই বেড়িবাঁধের কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।