ছোট ভাইয়ের করুণ মৃত্যুতে বাক্‌রুদ্ধ বোন নয়নতারা

নিজস্ব জেলা প্রতিবেদক : ‘ভাইবোনের জমানো টাকা দিয়ে বাড়িতে নতুন টিনের ঘর বানাইছি। ঈদে ওরা বাড়ি আসলে মিলাদ দিয়ে ঘরে ওঠার কথা আছিল। আমার বাবা ঘাটে আইসা ফোন করছিল। তখন বলছিল দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই ভাইবোনে বাড়ি পৌঁছাইব। আমার মানিক আইল লাশ হইয়া, অহন এই নতুন ঘরে কে থাকব?’

এই বিলাপ নাছিমা আক্তারের। তাঁর বাড়ি নড়িয়া উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামে। আজ বুধবার ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ফেরিতে পদদলিত হয়ে মারা গেছে তাঁর ছেলে আনসার আলী (১৫)।

আজ বেলা দুইটার দিকে আনছার আলীর মরদেহ কালিকাপ্রসাদ গ্রামে আনা হয়। সন্ধ্যায় স্থানীয় বাংলাবাজার গণকবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। তাদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, একসঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে ভাইয়ের মৃত্যুতে বোন নয়নতারা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। বাড়ির উঠানে বিলাপ করছেন মা নাছিমা আক্তার। স্বজনেরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নড়িয়া উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামের গিয়াস উদ্দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার মীরহাজির বাগ এলাকায় থাকতেন। তিনি, তাঁর স্ত্রী নাছিমা আক্তার, মেয়ে নয়নতারা ও ছেলে আনছার আলী বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। করোনার কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গিয়াস উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী ছয় মাস আগে গ্রামে ফিরে আসেন। আর ছেলে আনসার আলী একটি স্টিলের ফার্নিচারসামগ্রী তৈরির কারখানায় ও মেয়ে নয়নতারা পর্দা প্রস্তুতের কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে থাকেন। ঈদের কারণে কারখানা বন্ধ দেওয়ার পর বুধবার দুই ভাইবোন একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন।

বুধবার সকাল আটটায় দুই ভাইবোন শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছান। সকাল ১০টার দিকে শাহ্ পরান ফেরিটি পন্টুনে থামলে তাঁরা একে অপরের হাত ধরে ফেরিতে উঠতে যান। প্রচণ্ড ভিড়ে তাঁরা দুজন দুদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।

তখন আনছার আলী ছিটকে ফেরির মেঝেতে পড়ে যায়। পদদলিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ততক্ষণে ফেরি বাংলাবাজার ঘাটের দিকে চলতে শুরু করে। ফেরি বাংলাবাজার ঘাটে পৌঁছালে ভিড় সরিয়ে ভাইকে খুঁজতে থাকেন নয়নতারা। একসময় ফেরির মেঝেতে লাশ দেখে ভাইকে শনাক্ত করেন।

আনছার আলী ও নয়নতারার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন তাঁদের এক সহকর্মী বরিশালের বানারীপাড়া এলাকার সবুজ ঢালী। তিনিই আনছার আলীর লাশ উদ্ধার করে নড়িয়ায় নিয়ে আসেন। সবুজ ঢালী বলেন, ‘আমরা একত্রেই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম। শিমুলিয়া ঘাটে সকাল আটটায় পৌঁছে দেখি হাজার হাজার মানুষ। আমরা কোনো ফেরিতে উঠতে পারছিলাম না। ১০টার দিকে হুড়োহুড়ি করে একটি ফেরিতে উঠি। তখনই আনছার আমাদের কাছ থেকে ছিটকে যায়। ভিড়ের মধ্যে তাকে আর খুঁজে পাইনি। মনে হয়েছিল ফেরি তীরে ভিড়লে তাকে খুঁজে পাব। আমরা ভাবতেও পারিনি এভাবে তার লাশ পাব।’

বুধবার শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথের শাহ্ পরান ও এনায়েতপুরী ফেরিতে যাত্রীদের অতিরিক্ত ভিড়ে ও পদদলিত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আনছার আলী শাহ্ পরান ফেরির যাত্রী ছিল। দুপুর ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে ওই ফেরি থেকে আনসার আলীর লাশ উদ্ধার করেন।

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়ন্তী রূপা রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা ওই পরিবারটির পাশে থাকব। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে।’

Share