নয়াবার্তা প্রতিবেদক : জাল দলিল বন্ধক রেখে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ২৩ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন একজন ঠিকাদার। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নির্মাণের কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণের নামে এই অর্থ লোপাট হয়। লুটপাটের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তৈরি করা হয় রাজধানীর দক্ষিণখানের ৯০ শতাংশ জমির তিনটি খণ্ড জাল দলিল। পরে এসব জাল দলিল ব্যাংকে জমা দেওয়া হয় ঋণের বন্ধকী হিসাবে। এরপর ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে কৌশলে এ অর্থ উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার পাড়ি জমান বিদেশে। ঋণ গ্রহণের পর প্রায় ১৮ বছর চলে গেলেও এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি একটি টাকাও। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) রিপোর্টে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। জানা গেছে, ঋণ জালিয়াতির গ্রাহক মেসার্স শাহ ইসলাম কনস্ট্রাকশনস লিমিটেড। ব্যাংকের নথিতে গ্রাহকের ঠিকানা জীবন বীমা টাওয়ার (৯ম তলা) ১০, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা। অডিট রিপোর্টের সূত্র ধরে বুধবার সরেজমিন জীবন বীমা টাওয়ারের নবম তলায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে মেসার্স শাহ ইসলাম কনস্ট্রাকশনস লি. নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বিদেশে পালিয়েছেন। বন্ধকী জামানত ভুয়া হওয়ায় ঋণটি হয়ে পড়ে জামানতবিহীন। ফলে এই ঋণের টাকা আদৌ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে একটি মামলা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হয় অতিরিক্ত উপ-মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. আহসান হাবীবের সঙ্গে। তিনি জানান, জাল দলিলের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ বিতরণ করা অনিয়ম। বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় সেটি ঘটেছে। আমরা এ ঘটনার জবাব চেয়েছি। বিশেষ করে এই ঋণ বিতরণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি। কিন্তু জবাবে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ মামলার রায় অনুযায়ী আপত্তিকৃত টাকা আদায় আবশ্যক বলে মনে করি।
এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মো. আনিসুর রহমান জানান, এর সঠিক ব্যাখ্যাসহ উত্তর দিতে পারবে ব্যাংকের অডিট বিভাগ। তবে এই ঘটনা আমার সময় ঘটেনি। এরপরও নতুনভাবে যেন কোনো ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে। আর বিগত ঘটনাগুলো আইনিভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে।
বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখার ২০১৯ এবং ২০২০ সালের কর্মকাণ্ডের ওপর অডিট করেছে সিএজি অফিস। অডিট প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাল দলিলের বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করেছে ব্যাংক। কিন্তু মঞ্জুরিপত্রে বেশকিছু শর্ত থাকলেও সেটি উপেক্ষা করে ঋণটি গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের গ্রাহক হচ্ছে মের্সাস শাহ ইসলাম কনস্ট্রাকশনস লিমিটেড। ঋণ নেওয়ার আগে এই গ্রাহক জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য তৎকালীন প্রায় ৩৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ পায়। এর বিপরীতে ওই গ্রাহক বেসিক ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করে। ঋণের বিপরীতে তিনটি জমির মূল দলিল জমা দেয় ব্যাংকের শাখায়। জমি হচ্ছে ঢাকা জিলা দক্ষিণখানের সিএস ৩৬৩নং খতিয়ানের ১৪৯৯নং দাগের ৪৯ শতাংশ এবং সিএস ৪৬৫নং খতিয়ানের ২৮০৬ ও ২৮০৭নং দাগের ৪১ শতাংশ জমি। অর্থাৎ মোট জমির পরিমাণ ৯০ শতাংশ। দলিলগুলোর নম্বর হচ্ছে-২৭৬৩৪ তারিখ : ০২/১০/১৯৭৪, ২৭৬৩৫, তারিখ : ০২/১০/১৯৭৪ এবং ৫৬৯০, তারিখ ২৬/০৬/১৯৬৪। এসব ডকুমেন্টের বিপরীতে ঋণটি বিতরণ করা হয় ২০০৫ সালে।
ঋণ নেওয়ার পর গ্রাহক কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। এরপর ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন খন্দকারের মাধ্যমে দলিলগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু আইনজীবীর মতামতে বলা হয়েছে তিনটি দলিলই জাল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ধরনের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শাখা ম্যানেজার এবং ক্রেডিট অফিসার বা সেকেন্ড অফিসার কর্তৃক যৌথভাবে বন্ধকী সম্পত্তির দলিল, সীমা নির্ধারণ এবং মূল্যায়ন করার নিয়ম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ধরনের যে কাজ করেছে তার কোন রের্কড নেই ব্যাংকের নথিতে। এছাড়া মঞ্জুরিপত্রের অন্যান্য শর্তের মধ্যে এ ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থাপক বন্ধকী সম্পত্তি সঠিক ও মূল্যায়ন করার কথা। পাশাপাশি কার্যাদেশের বিপরীতে সরকারি অর্থ ছাড় নিশ্চিত হয়ে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তৎকালীন শাখা ম্যানেজার এসব নির্দেশনা পালন করেননি।
এই ঋণের বিপরীতে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) এএম মোফাজ্জল জানান, এই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমাদের এখন সর্বোচ্চ হাতিয়ার মামলা করা। সেটি করা হয়েছে। আশা করছি আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ঋণের দায় আদায় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি বলেন, বিষয়টি পরিষ্কার ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার যে নীতিমালা সেটি ভঙ্গ করা হয়েছে। এই যে গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জড়িত ছিল। তা না হলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কতগুলো নিয়ম আছে। এটা বোঝা যাচ্ছে পরস্পর যোগসাজশে এটি ঘটেছে। বেসিক ব্যাংকের মতো অন্যান্য ব্যাংকে একই ধরনে ঘটনার কারণে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বেড়েই চলছে। এই ঋণের প্রস্তাবনা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেই পাশ হয়েছে। এটি অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এই ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বিনিময়ে লাভবান হয়েছেন।
আরও যেসব অনিয়ম শনাক্ত : সিএজির রিপোর্টে ২০১৯ এবং ২০২০ সালের তদন্তে দেখা গেছে ১৩টি অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ৩৯৯ কোটি টাকা ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় ঘটনা বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায়। গ্রাহক আলী ট্রেডার্স ইন্টারন্যাশনাল ১৬ কোটি টাকার জামানত দিয়ে ১২৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এরপর আর পরিশোধ করেনি। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছে প্রধান শাখার গ্রাহক আজবিহা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. কে ঋণ দেওয়া হয় শর্ত ভঙ্গ করে। ঋণের অঙ্ক ১১২ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে বন্ধকী জমি দেওয়া হয় ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার জমি। গ্রাহক টাকা দিচ্ছে না। এছাড়া একই শাখার গ্রাহক বগুড়া ভান্ডার ইমপেক্স ৩৪ কোটি টাকার জমি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছে ৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু পরে দেখা গেছে জমির প্রকৃত মূল্য ৫ কোটি টাকা। ঋণের বিপরীতে জামানত কম থাকায় গ্রাহক ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত রয়েছেন। এছাড়া বারবার রপ্তানিতে ব্যর্থ হওয়ার পরও গ্রাহক লুমান ফ্যাশনকে ১৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এটি অর্থঋণ আদালত আইনের ২০০৩ এর ৪৬ ধারা লঙ্ঘন। সব ঋণ এখন খেলাপিতে রূপ নিয়েছে।