আনোয়ারা পারভীন : প্রবাসী আয়ে ঊর্ধমুখী ধারা ফিরে এসেছে। ডিসেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে ১০৬ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৭০ পয়সা হিসাবে যার পরিমাণ ১১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা ৯৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এটি পূর্ববর্তী নভেম্বর মাস এবং আগের বছরের ডিসেম্বর মাসের চেয়ে বেশি। গতকাল ১৭ ডিসেম্বর রোববার এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরের ১৫ দিনের প্রতিদিনে প্রবাসী আয় এসেছে ৭ কোটি ১৩ লাখ ১৮ হাজার মার্কিন ডলার। আগের বছর একই সময়ে এসেছিল ৫ কোটি ৬৬ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। এছাড়া চলতি বছরের নভেম্বরে প্রতিদিন এসেছিল ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে ডিসেম্বর মাসের ১৫ দিনে প্রবাসী আয় ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ছয় ব্যাংকর মাধ্যমে এসেছে ১০ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯২ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। আর দেশে ব্যবসারত বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২২ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন মার্কিন ডলার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে গত অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বর মাসে প্রবাসী আয় কমেছিলো। গত নভেম্বরে দেশে প্রবাসী আয় আসে ১৯৩ কোটি ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে ২১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। অথচ নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনের রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বিশ্লেষণে ধারনা করা হয়েছিলো যে, মাস শেষে প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। কিন্তু মাস জুড়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহে সকাল বিকাল নীতি পরিবর্তনের কারণে শেষ পর্যন্ত হুন্ডি কারবারীরাই লাভবান হয়।
গতকাল ১৭ ডিসেম্বর রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, নভেম্বর মাসে প্রতিদিন প্রবাসী আয় আসে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। আগের বছর নভেম্বর মাসে প্রতিদিন প্রবাসী আয় এসেছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৩ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের আগের মাস অক্টোবর মাসে এসেছিল ৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে আগের বছরের নভেম্বর মাসের তুলনায় প্রবাসী আয় বাড়লেও চলতি বছরের আগের মাস অক্টোবরের চেয়ে কমেছে। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে গত ৪৪ মাসের মধ্যে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈধপথে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় পাঠান। এর পরে প্রবাসী আয়ের ডলারের মূল্য বৃদ্ধি করে ১১০ টাকা পয়সা করা হয়। এরপর প্রবাসী আয়ে সরকারের দেওয়া ২ টাকা ৫০ পয়সা প্রণোদনার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও ২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়ায় অক্টোবর মাসে প্রবাসী আয় বাড়তে থাকে। ১০ নভেম্বর পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু নভেম্বর মাসের ১১ তারিখের পর প্রবাসী আয়ের ডলার দাম দুই দফায় ৭৫ পয়সা কমিয়ে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা পুনঃনির্ধারণ করার ফলে আয় কিছুটা কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৪ কোটি ৪২ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭২ কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। আর দেশে কর্মরত বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫৯ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে ১ থেকে ৩ নভেম্বর প্রথম সপ্তাহে ২০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। ৪ থেকে ১০ নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহে ৫৮ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স আসে। ১১ থেকে ১৭ নভেম্বর তৃতীয় সপ্তাহে ৩৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর চতুর্থ সপ্তাহে ৩০ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স আসে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আগের মাস অক্টোবরে প্রতিদিন প্রবাসী আয় এসেছিল ৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৬ মার্কিন ডলার। এর আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৩ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে আগের বছর নভেম্বর ও চলতি বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রবাসী আয় বেশি এসেছিলো। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সেই ধারায় ছেদ পড়ে। দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রবাসী আয়ে ঊর্ধমুখী ধারা ফিরে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস রেমিট্যান্স প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমেছিল। দেশে তীব্র ডলার সংকটের মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয়ে বড় হোঁচট খায়। ওই মাসে গত সাড়ে ৩ বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় দেশে আসে, যা পরিমাণে ১৩৪ কোটি ডলার। এর আগে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ১০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আর আগস্টে আসে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চের পর থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সংকট আরও প্রকট হয়। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন-অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় তারা সভা করে ডলারের রেট নির্ধারণ করে আসছে। সর্বশেষ ব্যাংকগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনার ক্ষেত্রে ডলারের ঘোষিত দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। প্রবাসী আয়ে দুই দফায় প্রনোদনা যোগ হচ্ছে আরো ৫ টাকা। অথচ দেশের বাইরে হুন্ডি বাজারে ডলার ক্রয় হচ্ছে ১২৫ থেকে ১২৮ টাকা দরে।
গত ১৩ ডিসেম্বর দেশের মুদ্রা বাজারে ডলারের স্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ায় মুদ্রাটির দাম তৃতীয় দফায় কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনগুলো। ভবিষ্যতে ডলারের দাম আরও কমবে।
সর্বশেষ ব্যাংকগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনার ক্ষেত্রে ডলারের ঘোষিত দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রি দর ১১০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজকে আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন হচ্ছে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা।
কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুণতে হচ্ছে ১২২ টাকা। চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের নগদ প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১২২ টাকা পর্যন্ত।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার এবং আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। এছাড়া সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার, অক্টোবর মাসে এসেছে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং নভেম্বর মাসে এসেছে ১৯৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ মার্কিন ডলার। আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ হয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।