তাঁর স্মৃতি দেখিয়ে দিল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছেই গোপন বন্দিশালার দরজা

বিবিসি : তদন্তকারীরা যখন রাতারাতি নির্মিত একটি দেয়াল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন, তখন গোপন কারাগারটির কয়েকটি সেল (কারাপ্রকোষ্ঠ) খুঁজে পান।

কারাগারটিতে নতুন ইট বাঁধানো একটি প্রবেশপথের সন্ধান পাওয়া যায়; যা ছিল মূলত পেছনে লুকিয়ে থাকা জিনিস আড়াল করার একটি চেষ্টা। প্রবেশপথটি দিয়ে ভেতরে ঢুকলে, সরু করিডোর। ডানে-বাঁয়ে ছোট ছোট ঘর। চারপাশটা মিসমিসে অন্ধকার।

মীর আহমেদ বিন কাসেম ও গুমের শিকার হয়েও ভাগ্যক্রমে ফিরে আসা অন্যদের স্মৃতিচারণা ছাড়া তদন্তকারী দলটি হয়তো এ গোপন কারাগার কখনোই খুঁজে পেত না। অথচ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খুব কাছেই এটির অবস্থান।

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেতার (শেখ হাসিনা) একজন সমালোচক মীর আহমেদ এ গোপন কারাগারে আট বছর বন্দী ছিলেন।

কারাগারে থাকার বেশির ভাগটা সময় মীর আহমেদের চোখ বেঁধে রাখা হতো। এ অবস্থায় শুনতে পাওয়া কিছু শব্দের কথা স্মরণে আছে তাঁর। উড়োজাহাজ অবতরণ করার সেই শব্দ তিনি স্পষ্ট মনে করতে পারেন।

মীর আহমেদের স্মৃতি তদন্তকারীদের বিমানবন্দরের কাছের একটি সামরিক ঘাঁটিতে যেতে সহায়তা করে। এ ঘাঁটির প্রাঙ্গণে থাকা প্রধান ভবনের পেছনে অপেক্ষাকৃত ছোট, সুরক্ষিত, জানালাবিহীন ইট ও কংক্রিটের একটি অবকাঠামো দেখতে পান তাঁরা। এখানে বন্দীদের আটকে রাখা হতো। কারাগারটি ছিল স্বাভাবিক দৃষ্টির অন্তরালে।

গণ–আন্দোলনের মুখে গত আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর আহমদ বিন কাসেমের মতো কয়েক শ ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন তদন্তকারীরা। তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির পর গোপন কারাগার থেকে অনেক বন্দী মুক্তি পান। আরও অনেকে বেআইনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছের ওই গোপন কারাগারসহ যারাই এমন কারাগারগুলো চালাত, তাদের একটি হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ইউনিট র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। তদন্তকারীরা বলেন, এ ইউনিট হাসিনার সরাসরি নির্দেশে কাজ করত।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জোরপূর্বক গুমের সব ঘটনা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন, সম্মতি বা নির্দেশে ঘটানো হতো।’

হাসিনার দল অবশ্য বলেছে, কথিত অপরাধগুলো তাঁর অজ্ঞাতসারে ঘটানো হয়েছে। তাই এসবের দায় তাঁর নয় এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ একাই এটির দেখভাল করেছে। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী।

সাত মাস হলো মুক্তি পেয়েছেন আহমেদ বিন কাসেম ও অন্যরা। কিন্তু যাঁরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে তাঁরা এখনো আতঙ্কিত। জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত এবং তাঁদের কাউকেই এখনো ধরা হয়নি।

আহমেদ বিন কাসেম বলেন, টুপি ও মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে কখনো যান না তিনি। বলেন, ‘আমি যখন বাইরে থাকি, তখন ক্ষতির আশঙ্কায় সব সময় সতর্ক থাকতে হয়।’

‘বিস্তৃত ও পদ্ধতিগত’ কারা নেটওয়ার্ক:- মীর আহমেদ যেখানে বন্দী ছিলেন সেটি বিবিসিকে দেখান তিনি। এ সময় তিনি ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন। ধাতবের একটি ভারী দরজা ঠেলে এগোনোর সময় মাথা নিচু করেন ও আরেকটি সরু পথ ধরে ‘নিজের’ কক্ষে ঢোকেন। এ কক্ষেই আট বছর বন্দী ছিলেন তিনি।

মীর আহমেদ বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মনে হতো, আমাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। বাইরের জগৎ থেকে আমি ছিলাম পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।’ তিনি যে কক্ষে ছিলেন, সেটিতে প্রাকৃতিক আলো আসার কোনো দরজা–জানালা ছিল না। কক্ষটিতে থাকার সময় তিনি দিন–রাতের পার্থক্য বুঝতেন না।

আহমেদ বিন কাসেম একজন আইনজীবী। চল্লিশের কোঠায় বয়স। আগেও তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, কিন্তু তিনি যে ছোট সেলটিতে ছিলেন, সেটি দেখাতে এ প্রথম বিবিসির প্রতিনিধিকে নিয়ে যান।

টর্চলাইটের আলোয় দেখা গেল, কক্ষটি এত ছোট যে, স্বাভাবিক আকৃতির একজন মানুষের সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন। ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কিছু দেয়াল ভেঙে গেছে এবং ইট ও কংক্রিটের টুকরা মাটিতে ছড়িয়ে আছে। এটি যে অপরাধীদের (গুম করার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট) অপরাধের প্রমাণ ধ্বংস করার শেষ চেষ্টা, বোঝাই যায়।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘(এটি) বন্দীশালাগুলোর একটি। দেশজুড়ে আমরা এমন ৫০০, ৬০০, ৭০০ এর বেশি সেলের সন্ধান পেয়েছি। এতে বোঝা যায়, এটি (গোপন কারা নেটওয়ার্ক) ছিল বিস্তৃত ও পদ্ধতিগত।’ গোপন কারাগার পরিদর্শনকালে বিবিসির প্রতিনিধির সঙ্গে তাজুল ইসলামও ছিলেন।

এ যেন মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণার’:- আহমেদ বিন কাসেম যে কক্ষে বন্দী ছিলেন, সেখানে থাকা হালকা নীল টাইলসের কথা তাঁর পরিষ্কার মনে আছে। টাইলসগুলো এখন টুকরা হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। নিচতলার সেলগুলোর তুলনায় এটি ছিল বড়। আয়তনে ১০ ফুট বাই ১৪ ফুট (৩ মিটার বাই ৪ দশমিক ৩ মিটার)। একপাশে বসার উপযোগী টয়লেট।

মীর আহমেদ তাঁর যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি তুলে ধরার সময় কক্ষজুড়ে হাঁটছিলেন। বর্ণনা করছিলেন, আট বছর বন্দী অবস্থায় সেখানে কীভাবে কাটিয়েছেন। গ্রীষ্মে কক্ষের ভেতরটা থাকত অসহনীয় গরম। কিছুটা বাতাস যাতে পাওয়া যায়, সে জন্য গরমের সময় দরজার কাছে মুখ রেখে মেঝেতে উপুড় হয়ে থাকতেন।

গুমের শিকার হওয়া এ আইনজীবী বলেন, ‘এ যেন মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণার।’ যন্ত্রণা ভোগের স্মৃতিচারণা করতে এ কক্ষে তাঁর আবারও আসাটা কঠিন। তবে তিনি মনে করেন, কী ঘটেছে, তা বিশ্বকে দেখানো জরুরি।

‘যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ফ্যাসিবাদী শাসনকে সহায়তা ও মদদ দিয়েছিলেন, তাঁরা এখনো নিজেদের অবস্থানে আছেন’, বলেন মীর আহমেদ।

মীর আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের এ গল্প প্রকাশ করা উচিত। (গুমের শিকার) যাঁরা ফেরেনি, তাঁদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং যাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সংগ্রাম করছেন, তাঁদের সহায়তা করা উচিত আমাদের।’

এর আগে বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, মীর আহমেদকে আয়নাঘর নামে পরিচিত এক কুখ্যাত বন্দীশালায় আটকে রাখা হয়েছিল। এটি ছিল ঢাকায় সামরিক গোয়েন্দা সদর দপ্তরে। তবে তদন্তকারীরা এখন মনে করেন, এ রকম আরও অনেক গোপন বন্দিশালা রয়েছে।

বিন কাসেম বিবিসিকে বলেন, গুম হওয়ার পর প্রথম ১৬ দিন ছাড়া তিনি তাঁর পুরো আটককাল র‍্যাবের ঘাঁটিতে কাটিয়েছেন। তদন্তকারীদের এখন সন্দেহ, তাঁকে প্রথম যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল, তা ঢাকায় পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কার্যালয়।

বিন কাসেমের বিশ্বাস, তাঁকে তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে গুম করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তিনি তাঁর বাবার প্রতিনিধিত্ব করেন। বাবা মীর কাসেম আলী ছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য। শেখ হাসিনার সরকারের সময় তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।

বিবিসির সঙ্গে আলাপে আরও পাঁচ ব্যক্তি বলেছেন, তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং হাতকড়া পরিয়ে কংক্রিটের তৈরি অন্ধকার কক্ষে রাখা হয়েছিল। বাইরে বের হওয়ার সুযোগ তাঁদের ছিল না। তাঁরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছে।

এসব মানুষ তাঁদের সঙ্গে হওয়া ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটির সত্যতা বিবিসি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। তবে তাঁদের প্রায় সবাই একটি আতঙ্কের কথা বলেছেন। সেটা হলো, তাঁদের মনে হয় যে একদিন হয়তো রাস্তায় বা বাসে কোনো অপহরণকারীর সঙ্গে তাঁরা আচমকা ধাক্কা খাবেন।

৩৫ বছর বয়সী আতিকুর রহমান রাসেল বলেন, ‘এখন, যখনই আমি গাড়িতে উঠি বা বাড়িতে একা থাকি, তখন আমি কোথায় ছিলাম, তা ভেবে ভয় পাই। আমি ভাবতে থাকি, কীভাবে আমি বেঁচে গেলাম, আমার কি সত্যিই বেঁচে থাকার কথা ছিল।’

রাসেল বলেছেন, তাঁর নাক ভেঙে গিয়েছিল এবং তাঁর হাতে এখনো ব্যথা হয়। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে হাতকড়া পরাত এবং অনেক মারধর করত।’

রাসেলের বর্ণনা অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ যখন তীব্র আকার ধারণ করেছিল, তখন পুরান ঢাকার একটি মসজিদের বাইরে একদল লোক তাঁর দিকে এগিয়ে আসে। তাঁরা নিজেদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই লোকগুলো রাসেলকে বলেছিলেন, তাঁকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে।

এক মিনিটের ম্যধে রাসেলকে একটি ধূসর রঙের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর হাতে হাতকড়া পরানো ছিল, মাথা ঢেকে রাখা হয়েছিল এবং চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। ৪০ মিনিট পর, তাঁকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে একটি কক্ষে রাখা হয়।

রাসেল বলেন, প্রায় আধঘণ্টা পর একের পর এক লোক সেখানে আসতে থাকেন এবং নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। তিনি কে, কী করেন এসব বিষয় জানতে চান। তারপর তাঁকে মারধর শুরু হয়।

রাসেল বলেন, ‘ওই জায়গার ভেতরে থাকাটা ভয়ংকর ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি আর কখনো বের হতে পারব না।’

বর্তমানে বোন ও বোনের স্বামীর সঙ্গে থাকেন রাসেল। ঢাকায় বোনের ফ্ল্যাটে বসে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি তাঁর কয়েক সপ্তাহের আটকাবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

রাসেলও বিশ্বাস করেন, তাঁকে আটক রাখার ঘটনাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ, তিনি তখন বিরোধী দল বিএনপির ছাত্রসংগঠনের নেতা। তাঁর বাবা ছিলেন একই দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য। তাঁর প্রবাসী ভাই প্রায়ই শেখ হাসিনার সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিতেন।

রাসেল বলেন, তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা জানার কোনো উপায় ছিল না। তবে চলতি বছরের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনটি আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করতে দেখার পর, তাঁর মনে হয়েছে তাঁকে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় রাখা হয়েছিল।

‘আমাকে বলা হয়েছিল, আমি গায়েব হয়ে যাব’:- সাবেক বন্দী, বিরোধী মতাবলম্বী এবং তদন্ত কর্মকর্তারা এমনটাই বলেছেন, এটা সবাই জানতেন যে হাসিনা রাজনৈতিক ভিন্নমতকে একেবারেই সহ্য করতেন না। তাঁর সমালোচনা করলে কোনো ধরনের চিহ্ন ছাড়াই আপনি ‘উধাও’ হয়ে যেতে পারেন। তবে কত মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন, তার প্রকৃত সংখ্যা হয়তো কখনোই জানা যাবে না।

বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে গুম হওয়া মানুষের তালিকা তৈরি করছে। তাদের তালিকা অনুযায়ী, অন্তত ৭০৯ জন গুম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫৫ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। গুমের ঘটনা নিয়ে তদন্ত করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশনের কাছে গুমের শিকার হয়েছেন দাবি করে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আরও মানুষ অভিযোগ নিয়ে আসছেন। তবে এটা প্রকৃত সংখ্যা নয়। ধারণা করা হয়ে থাকে, মোট সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

মীর আহমেদ বিন কাসেমের মতো মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাজুল ইসলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এসব বন্দিশালার পেছনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করতে সক্ষম হয়েছেন।

বিভিন্ন জায়গায় বন্দী থাকলেও ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা অদ্ভুত রকমভাবে প্রায় একই রকম।

হাসিনার আওয়ামী লীগ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি লোকজনকে জোর করে গুম করা হয়েও থাকে, সেটা শেখ হাসিনা বা তাঁর মন্ত্রিসভার কারও নির্দেশে হয়নি। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গেছেন।

আরাফাত বলেছেন, ‘যদি এমন কোনো আটকের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা জটিল অভ্যন্তরীণ সামরিক কোনো পদক্ষেপের ফসল হয়ে থাকতে পারে। এসব মানুষকে গোপন বন্দিশালায় আটকে রেখে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোনো রাজনৈতিক ফয়দা আমি দেখতে পাই না।’

সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, এ সব বিষয়ে তাঁদের কিছু জানা নেই।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়িদ বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী স্পষ্টভাবে এ ধরনের কোনো বন্দিশালা পরিচালনার বিষয়টি নাকচ করছে।’

তাজুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এসব কারাগারে যে মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সেটিই এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘এখানে যাঁদের বন্দী রাখা হয়েছিল, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং তাঁরা শুধু আগের সরকারের, ওই সময়ের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই কারণেই তাঁদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।’

এখন পর্যন্ত তাঁরা ১২২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, কিন্তু এখনো কাউকে বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
এ কারণে ৭১ বছর বয়সী ইকবাল চৌধুরীর মতো ভুক্তভোগীদের আশঙ্কা, তাঁদের জীবন এখনো ঝুঁকিতে। ইকবাল চৌধুরী বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চান। ২০১৯ সালে ছাড়া পাওয়ার পর কয়েক বছর ধরে তিনি নিজের বাড়ি থেকে বাইরে কোথাও বের হননি, এমনকি বাজারে পর্যন্ত যাননি। ইকবাল চৌধুরীকে যাঁরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা হুমকি দিয়ে আটকের বিষয়ে তাঁকে মুখ খুলতে নিষেধ করেছেন।

ইকবাল চৌধুরী বলেন, তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘যদি আপনি কখনো কোথায় ছিলেন বা আপনার সঙ্গে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে মুখ খোলেন এবং আপনাকে যদি আবার নিয়ে যাওয়া হয়, তবে আর কেউ আপনাকে খুঁজে পাবেন না বা দেখতে পাবেন না। আপনি এই দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে যাবেন।’

ইকবাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ আনা হয় এবং তিনি বলেন, এ কারণেই তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।

ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, মারধর করা হয়েছে। ইলেকট্রিক শকের কারণে এখন আমার একটি আঙুল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমার পায়ের জোর কমে গেছে, শরীরের জোরও কমে গেছে।’

ইকবাল অন্য মানুষদের শারীরিক নির্যাতন, মানুষের চিৎকার এবং যন্ত্রণায় কান্নার শব্দ পাওয়ার কথা তাঁর মনে পড়ে। তিনি বলেন, ‘আমি এখনো আতঙ্কিত।’

২৩ বছরের রহমতুল্লাহও আতঙ্কে ভুগছেন। তিনি বলেন, ‘তারা আমার জীবন থেকে দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। ওই সময়টা আর কখনোই ফিরে পাব না।’

রহমতুল্লাহ আরও যোগ করেন, ‘তাঁরা আমাকে এমন এক জায়গায় রেখেছিল, যেখানে কোনো মানুষেরই থাকা উচিত নয়।’

২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট মধ্যরাতে নিজের বাড়ি থেকে রহমতুল্লাহকে উঠিয়ে নেন র‍্যাব কর্মকর্তারা। ওই সময় র‍্যাব কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ইউনিফর্ম পরা ছিলেন। আবার কেউ কেউ সাদা পোশাকে ছিলেন। তখন পাশের একটি শহরে রান্নার কাজ করতেন রহমতুল্লাহ। সেই সঙ্গে তিনি ইলেকট্রিশিয়ান হতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।

বারবার জিজ্ঞাসাবাদের পর রহমতুল্লাহর কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতবিরোধী এবং ইসলামি পোস্ট করার জেরেই তাঁকে জোরপূর্বক আটক করা হয়েছে। তাঁকে যেই কক্ষে (সেল) আটক রাখা হয়েছিল, কাগজে-কলমে ব্যবহার করে তিনি সেটার ছবি আঁকেন। ওই কক্ষে একটি খোলা ড্রেন ছিল। সেখানেই তাঁকে মল–মূত্র ত্যাগ করতে হতো।

রহমতুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকার ওই জায়গাটার কথা ভাবলে এখনো আমি আতঙ্ক বোধ করি। সেখানে ঠিকমতো শোয়ার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। তাই আমাকে কোমর বাঁকা করে ঘুমাতে হতো। শুয়ে থাকার সময় আমি পা ছড়িয়ে দিতে পারতাম না।’

‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন মাইকেল চাকমা:- বিবিসির পক্ষ থেকে আরও সাবেক দুই বন্দীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন-মাইকেল চাকমা ও মাসরুর আনোয়ার। তাঁদের দেওয়া তথ্যে গোপন বন্দিশালা এবং সেগুলোর ভেতরে তাঁদের সঙ্গে আসলে কী ঘটেছিল, সেসব নিয়ে ধারণা লাভের চেষ্টা করা হয়েছে।

কয়েকজন ভুক্তভোগী আটক থাকার সময়ে হওয়া শারীরিক ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের প্রায় সবাই বন্দী থাকার সময়কার অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণার কথা বলেছেন।

বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। টানা কয়েক বছরের স্বৈরশাসনের পর দেশটিতে পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে। এসব অপরাধে জড়িত অপরাধীদের ন্যায্যবিচারের ব্যবস্থা করার সক্ষমতা অর্জন করাটা গণতন্ত্রের দিকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে দেখা হবে।

তাজুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এটা (বিচার) সম্ভব এবং একদিন অবশ্যই হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে। ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তারা অবর্ণনীয় কষ্ট করেছেন।’

কংক্রিটের তৈরি যে কক্ষে মীর আহমদ বিন কাসেম বন্দী ছিলেন, সেটার অবশিষ্টাংশের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর অবশ্যই বিচার হতে হবে, যাতে দেশ এ অধ্যায়টি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে।’

রহমতুল্লাহর জন্য এটা এতটাও সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘ভয় এখনো যায়নি। মৃত্যু পর্যন্ত আমার এই ভয় থাকবে।’

Share