তাবলীগ জামায়াতে সাদ-জুবায়ের কর্তৃত্বের লড়াই


নয়াবার্তা প্রতিবেদক : তাবলিগ জামাত রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এবং অহিংসার জন্য দুনিয়াজুড়ে পরিচিত। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এই অরাজনৈতিক জামায়াতের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবধারার নেতৃত্ব প্রবেশ করায় অহিংস সংগঠনটির ভেতর দুটি গ্রুপের দ্বন্ধের সূত্রপাত হয়। এই দ্বন্ধ চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। একটি গ্রুপ মাওলানা জুবায়েরপন্থি হিসেবে পরিচিত। অপরটি মাওলানা সাদের অনুসারী। মূলত, কর্তৃত্ব নিয়েই তাবলীগ জামায়াতের এই দুই গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে বিবাদ চলে আসছে। যদিও জুবায়েরপন্থিরা বলছেন- ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির ইসলাম পরিপন্থি কিছু বক্তব্যের কারণেই বিরোধের সৃষ্টি। আবার সাদ অনুসারীদের ভাষ্য- ঐতিহ্য ভেঙে আমিরের পরিবর্তে শুরায়ে নেজামের (পরামর্শ সভা) মাধ্যমে তবলিগ পরিচালনা নিয়েই মূল বিরোধ। এই বিরোধের জেরেই রাজধানীর টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে বিবাদমান দুপক্ষের সংঘর্ষে গত মঙ্গলবার রাতে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক।

জানা যায়, তাবলীগে মূল সমস্যার সূত্রপাত হয় ২০১৪ সালে। এই সংঘাতের দুই পক্ষে আছেন দিল্লি মারকাজের আমির সাদ কান্ধলভি এবং বাংলাদেশের তাবলীগের খতিব মাওলানা জুবায়ের। তাবলীগের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের প্রশ্ন নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত হয় ২০১৪ সালে যখন সাদ কান্ধলভি নিজেকে আমির বলে ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা তাবলীগের এক পক্ষের মতে, ১৯৯৬ সালে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপন্থি। কেননা, ১৯৯৬ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল- তিন সদস্যের একটি শুরা সংগঠন পরিচালনা করবেন; প্রতি সপ্তাহে একজন ফয়সাল থাকবেন, যিনি ওই সপ্তাহের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই শুরার একজন মারা গেলে মাওলানা সাদ এবং আরেকজন তবলিগ জামাত পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে শুরার দ্বিতীয় সদস্যের মৃত্যুর পর মাওলানা সাদ নিজেকে আমির হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপরই মূলত দুপক্ষের মধ্যে দ্বন্ধের সূত্রপাত। যদিও এই দ্বন্ধ প্রকাশ্য রূপ নেয় ২০১৭ সালে।

ওই বছর মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্য নিয়ে তাবলীগে ভিন্নমত এবং বিতর্কের সূচনা হয় এবং সংগঠনের আমিরের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কাকরাইলে দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর ১৩ সদস্যের একটি শুরা কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তাবলীগের একাংশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়- যেখানে সাদ কান্ধলভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে এবং বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে তাবলীগের একাংশ মাওলানা সাদের পক্ষ নেয় এবং অন্যপক্ষ থাকে নবগঠিত শুরার পক্ষে। এরপর থেকেই সাদ বাংলাদেশে ইজতেমায় অংশ নিতে পারছেন না। এসব বিতর্কের সূত্র ধরেই মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে নিয়ে বিভিন্ন সময় দুপক্ষ পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে পড়ে এবং ২০১৮ সালে মাওলানা সাদ ঢাকায় এসেও বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে পারেননি। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক বছর বিশ্ব ইজতেমার সময় এ নিয়ে চাপা বিরোধ চলে আসছে। আর মাওলানা সাদও ইজতেমায় অংশ নিতে পারছেন না।

এদিকে ২০১৭ সাল থেকেই সরকারের মধ্যস্থতায় টঙ্গীর তুরাগতীরে পৃথক ইজতেমা করছে জুবায়েরপন্থি ও সাদপন্থিরা। চলতি বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জুবায়েরপন্থি হেফাজতে ইসলামের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, টঙ্গীতে আর সাদপন্থিদের ইজতেমা করতে দেয়া হবে না। ইজতেমা একটাই হবে- এটা জুবায়েরপন্থিদের। এরই অংশ হিসেবে গত ৫ নভেম্বর সাদবিরোধী ওলামা-মাশায়েখরা ঢাকায় সমাবেশ করে সাদপন্থিদের নিষিদ্ধসহ ৯ দফা দাবি জানান। এই সমাবেশের আগে তবলিগের দুই গ্রুপই পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ডাক দিলে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সাদপন্থিরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। এসব কারণে এবার ইজতেমায় বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছিল প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহল থেকে, যা গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঘটে গেল।

এ বিষয়ে সাদপন্থিদের শীর্ষ মুরব্বি সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলেছেন, ইজতেমায় যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ওদের (জুবায়েরপন্থি) মাঠের বরাদ্দ ছিল ১৬ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত। জোড়ের জন্য মাঠ প্রস্তুতে আমরা বুধবার ভোরে টঙ্গী যাই। সেখানে ওরা হামলা করে। তবলিগ জামাত রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এবং অহিংসার জন্য দুনিয়াজুড়ে পরিচিত। বাংলাদেশে কেন বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে ওয়াসিকুল ইসলাম বলেন, সমঝোতার জন্য তিনবার চিঠি দিয়েছি। ওরা বলে, আমরা নাকি মুসলমানই নই; আমাদের সঙ্গে কী আলোচনা! এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেফাজতের নেতারা তবলিগে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বিতর্ক তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, মাওলানা সাদ ভুল কিছু বলেননি। তার বিরোধীরা ২০১৫ সালে প্রস্তাব করেছিলেন, আমিরের পরিবর্তে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত পরামর্শ পরিষদ পরিচালনা করবে তবলিগ। তা না হওয়ায় হিংসা থেকে মাওলানা সাদকে আমির পদ থেকে সরাতে তার বক্তব্যকে ইসলামবিরোধী বলা হচ্ছে।

অন্যদিকে, জুবায়েরপন্থি হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেছেন, ২০১৮ সালের মতো এবারো হামলা করেছে সাদের অনুসারীরা। এবার তাদের ইজতেমা করতে দেয়া হবে না। সাদকেও বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না।

জানা যায়, ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দিনে ১৯২৪ সালে তবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি। ধীরে ধীরে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে তবলিগের কার্যক্রম। একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে কাজ করতে ষাটের দশক থেকে প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমায় একত্রিত হন তবলিগ জামাতের অনুসারীরা। ২০১০ সাল পর্যন্ত এক পর্বে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হলেও অতিরিক্ত লোক সমাগমের কারণে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। দুই পর্বেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তবলিগ অনুসারীরা অংশ নিতেন। এতে বয়ান করতেন ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তবলিগের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা।

তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি ছিলেন সংগঠনের প্রথম আমির। তার মৃত্যুর পর ছেলে ইউসুফ কান্ধলভি আমির হন। সাদ কান্ধলভি তার নাতি। মাওলানা সাদ ২০১৬ সালে এক অভিমতে জানান, ইসলাম শিক্ষার বিনিময়ে টাকা নেয়া জায়েজ নয়। সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে মাদ্রাসাশিক্ষকদের মসজিদে এসে নামাজ আদায়ে জোর দেন তিনি। এ বক্তব্যকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়েছে দেওবন্দ দারুল উলুমকে অনুসরণ করা বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাপড়ুয়ারা। সাদপন্থিদের ভাষ্য, কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হেফাজতে ইসলামের নেতাদের হাতে। তারা ইসলামী শিক্ষা দিয়ে, ওয়াজ করে টাকা নেন। এ কারণেই সাদ কান্ধলভির বক্তব্যকে মানতে পারছেন না তারা। অন্যদিকে, বাংলাদেশে তাবলীগ জামায়াত নিয়ন্ত্রিত হয় কাকরাইল মসজিদ থেকে। বাংলাদেশে তাবলীগ জামায়াতের খতিব মাওলানা জুবায়ের আহমদও সাদ কান্ধলভির বক্তব্যের বিরোধী। হেফাজত নেতারা মাওলানা জুবায়েরের মতের সমর্থক। তারা বলছেন- সাদ কান্ধলভিকে তওবা করতে হবে।

তাবলীগের অনুসারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন মুসলিমকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান পালনে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে তাবলীগ জামায়াত। তাবলীগ জামায়াত মূলত মুসলমানদের মধ্যেই ধর্মীয় বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে। যারা নামাজ, রোজা এবং এ জাতীয় ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বিমুখ থাকেন তাদের ধর্মমুখী করতে মসজিদভিত্তিক কাজ করে থাকে সংগঠনটি।

Share