নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও বাধার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
শুক্রবার (৩১ মার্চ) প্রকাশিত তিন মাসের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আসক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লেখিত তিন মাসের মধ্যে সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
আলোচিত কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হামলা ও বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। এর পাশাপাশি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ছিল উল্লেখ করার মতো। বিশেষত গত ১২ ফেব্রুয়ারি (২০২৩) কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে গণরুমে নেত্রীদের কথা না শোনার অভিযোগ তুলে এক শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন চালানোর ঘটনা ছিল নিষ্ঠুর ও অমানবিক।
‘গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় নির্যাতনের শিকার দুই ছাত্রকে হাসপাতালের আইসিইউতে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের এক ছাত্রকে হলের একটি কক্ষে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা গুরুতর। ছাত্রলীগের মতো প্রাচীনতম একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ সংগঠনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময়ে র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা ছিল বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার নিকৃষ্ট উদাহরণ। র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বেআইনি আটক, নির্যাতনের অভিযোগগুলোর যথাযথ প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না বলে জনমানুষের মধ্যে সৃষ্ট ধারণা বিস্তৃত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। বিশেষত প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে সিআইডি পরিচয়ে ভোররাতে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং দিনভর তাকে আটকের ঘটনা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায়োগিক আচরণ যে অসঙ্গত ও বেআইনি তা প্রতীয়মান হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে ভোররাতে বিনা পরোয়ানায় তুলে নিয়ে আটক রাখার মতো অপতৎপরতা এই ধরনের হয়রানিমূলক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে। এ ধরনের নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের অভিযোগ সাতক্ষীরা জেলায় কর্মরত সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে আটকের সময়ও পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছিল। রঘুনাথ খাঁকে আটকের পর পুলিশ দিনভর অস্বীকার করে, প্রায় ৯ ঘণ্টা পরে একটি মামলায় গ্রেফতার দেখায়। এছাড়াও গুলশানের বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ সংগ্রহকালে দৈনিক কালের কণ্ঠের সাংবাদিক জহিরুল ইসলামকে গুলশান থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করে।
বহুল আলোচিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের মামলা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিরোধ করে তুলতে প্ররোচিত করবে। এ ধরনের পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে আইনমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা গ্রহণের পূর্বে বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার প্রতিফলন এ ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। বরং উচ্চ পদস্থ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রথম আলোর প্রতিবেদক এবং সম্পাদক সম্পর্কে নানা মন্তব্য এ ধরনের মামলা দায়ের করতে অতিউৎসাহীদের অনুপ্রাণিত করছে বলে মনে হচ্ছে। সাংবাদিক শামসুজ্জামানের আটক ও সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে আরও মামলা হতে যাচ্ছে। এ খবর আমরা পেয়েছি। এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। যা আমাদের বিস্মিত করেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা: জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, বিগত তিন মাসে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৩৭৪ জন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যু: গত তিন মাসে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৩ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ জন পুলিশের হাতে এবং ২ জন র্যাবের নিহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে র্যাব ও পুলিশের শারীরিক নির্যাতনে ২ জন এবং র্যাবের গুলিতে ১ জন নিহত হন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ: পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ অনুযায়ী, সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৪ জনকে অপহরণ করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে পরবর্তী সময় ৪ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মতো এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সীমান্ত সংঘাত: সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৫ বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া আহত হয়েছেন ৬ জন।
কারা হেফাজতে মৃত্যু: এই সময়কালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ২৬ জন। এর মধ্যে কয়েদি ১১ জন এবং হাজতি ১৫ জন।
গণপিটুনিতে নিহত: গত তিন মাসে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন মোট ১১ জন। এরমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৫ জন করে এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন নিহত হন।