নয়াবার্তা প্রতিবেদক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অন্তত ৩৮২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাঁদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের নেতা, যাঁরা ইতিমধ্যে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন এই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ, রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাই ও ইসির আপিলে বাদ পড়াদের অনেকে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। ভোটের আগপর্যন্ত আরও কেউ কেউ প্রার্থিতা ফিরে পেতে পারেন। এবার তুলনামূলক স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি বগুড়ায়। এই জেলার ৭টি আসনের ৬টিতে স্বতন্ত্র আছেন মোট ১৮ জন। এর মধ্যে বগুড়া-১ ও ৩ আসনে ৪ জন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন।
এবারের নির্বাচনে প্রায় ৪০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর রেকর্ড হয়নি। ইসি সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ছিল ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে ৪৮৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এর মধ্যে ছয়জন জিতেছিলেন।
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। এর আগে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি। সেবার ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। তখন এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। এবার যাতে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী না হন, সেদিকে সতর্ক ছিল আওয়ামী লীগ। সে জন্য দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে দল থেকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এবার কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পাননি।
এখন নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত দল আছে ৪৪টি। এর মধ্যে ভোটে ২৭টি দলের প্রার্থী আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬৬টি আসনে (এর মধ্যে তিনজন উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন) প্রার্থী আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।
এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী আছে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। ইসির তথ্য অনুযায়ী, ২৬৫টি আসনে প্রার্থী আছে দলটির। এর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ২৬টি আসনে তাদের সমর্থনে নিজেদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয় আওয়ামী লীগ। অবশ্য এককভাবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া যেসব আসনে জাতীয় পার্টি লড়েছে, সেখানে তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। একই অবস্থা ১৪-দলীয় জোট শরিকদেরও। এবারের নির্বাচনে এই জোটের শরিকদের আওয়ামী লীগ যে ছয়টি আসন দিয়েছে, সেগুলোতে তারা ভোট করবে নৌকা প্রতীকে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দিয়েছে হঠাৎ করে নিবন্ধন পেয়ে আলোচনায় আসা তৃণমূল বিএনপি। ১৩৩টি আসনে দলটির প্রার্থী আছে। এর বাইরে ১০০টির বেশি আসনে প্রার্থী আছে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি)। তারা ১২২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। তবে রাজনীতি বা ভোটের মাঠে এই দলের তেমন কোনো প্রভাব নেই।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে জাসদ ৬৪ আসনে, ওয়ার্কার্স পার্টি ২৬ আসনে, তরীকত ফেডারেশন ৩৮ আসনে, জেপি ১৩ আসনে, সাম্যবাদী দল ৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
এর বাইরে অন্য দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট ৩৯ আসনে, ইসলামী ঐক্যজোট ৪২ আসনে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ২৯ আসনে, গণফোরাম ৯ আসনে, গণফ্রন্ট ২১ আসনে, জাকের পার্টি ২১ আসনে, বিকল্পধারা ১০ আসনে, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৩৭ আসনে, বাংলাদেশ কংগ্রেস ৯৫ আসনে, কল্যাণ পার্টি ১৬ আসনে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ১১ আসনে, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ৫ আসনে, বিএনএম ৫৪ আসনে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৫ আসনে, বিএনএফ ৪৫ আসনে, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪ আসনে, সুপ্রিম পার্টি ৭৯ আসনে, সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট ৬৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই দলগুলোর কোনোটিই আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার সামর্থ্য রাখে না। তবে এবারে নির্বাচনের নতুনত্ব হচ্ছে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। অন্তত ১২৭টি আসনে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজ দলের নৌকার প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান ২৮ জন সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন ৩৫ জন। তাঁদের বাইরে সাবেক সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী আরও অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
এর আগে বিএনপিবিহীন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনেও দেখা গিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীরা। ২০২১-২২ সালে সাত ধাপে সারা দেশের ৪ হাজার ১১১টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পেয়েছিলেন ২ হাজার ১৭০টিতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ১ হাজার ৫৭৩টিতে। এর মধ্যে ৯১১ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। সে নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ভোটকেন্দ্রিক সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এবারের নির্বাচনটা হচ্ছে মূলত বিরোধী দল অন্বেষণের নির্বাচন। যে কারণে এত সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সরকারি দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেছে। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীদের বাইরে যারা নির্বাচনে আছে, তারাও অনুগত। এসব দলের সামর্থ্য খুব একটা নেই। বিরোধীও কেউ নেই। নির্বাচন হচ্ছে মূলত নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে নৌকার ‘ডামি’ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর।