নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে। তার ঠিক আগে একটি জনমত জরিপ করেছিল গেলপ নামের ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে একটিই প্রশ্ন পাঠিয়েছিল গেলপ। সেটি হচ্ছে, কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ—কর্মসংস্থান সৃষ্টি, না বাজেট ঘাটতি কমানো?
বলা বাহুল্য, ৬৫ শতাংশের জবাব ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টির পক্ষে। আর ২৮ শতাংশ মত দেয় বাজেট ঘাটতি কমাতে। বাকি ৭ শতাংশ কোনো জবাব দেয়নি। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর ১৯৯৩ সালের মে-জুন সংখ্যা থেকে তথ্যটি জানা গেছে।
করোনার এ সময়ে তথ্যটি উল্লেখ করার কারণ, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ছে। তবে কর্মসংস্থানের কী হবে, সে হিসাব এখনো সরকার করেনি। বাজেট ঘাটতি এবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশের মতো হবে বলে অনুমান করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ অনুমান সত্যি হলে টাকার অঙ্কে তা দাঁড়াবে ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, দেশের ইতিহাসে এটাই হবে সর্বোচ্চ বাজেট ঘাটতির উদাহরণ। এরই মধ্যে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলেছে, এ সময়ে সরকারকে ধার করে হলেও বেশি বেশি খরচ করতে হবে। সংগত কারণে তাই ঘাটতিটাও বড় হবে।
চলতি অর্থবছরের জন্য অনুদান ছাড়া সার্বিক বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল জিডিপির ৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এ ঘাটতিসহ চলতি অথর্বছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান বাস্তবতায় ঘাটতি জিডিপির ১ শতাংশ বা ৩০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়াবে পৌনে দুই লাখ কোটি টাকায়।
বিশাল এ ঘাটতির অর্থায়ন হবে কীভাবে, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি, তাতে বাজেট ঘাটতি বড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে পথ আমরা বের করে ফেলব।’ তবে কীভাবে করবেন, তা আর খোলাসা করেননি অর্থমন্ত্রী।
ঘাটতি পূরণের উপায় কী
কোনো সরকারের এক অর্থবছরের আয়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা যতটুকু বেশি হয়, সেটাই হচ্ছে বাজেট ঘাটতি। আয় কম হলে উন্নয়নকাজের জন্য ব্যয় কম হয়। উন্নয়নকাজে ব্যয় বাড়াতেই করা হয় ঘাটতি বাজেট। উন্নয়নকাজ হলে জনগণই উপকৃত হয়। আর এ কারণেই একশ্রেণির অর্থনীতিবিদ ঘাটতি বাজেটের পক্ষে থাকেন।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এই সংকটময় সময়ে বাজেট ঘাটতির দিকে তাকালে চলবে না। মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রশ্নই এখন বড়।
চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ১,৪৫,৩৮০ কোটি টাকা। করোনার কারণে বাড়ছে আরও ৩০ হাজার কোটি টাকা।
তবে বিপক্ষেও যুক্তি আছে। ঋণের বিপরীতে সরকারকে চড়া সুদ দিতে হয়। বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যয় করতে হয় সুদ পরিশোধে। ফলে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায় এবং কমে যায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। অনেক অর্থনীতিবিদ এ জন্য ঘাটতি বাজেটের বিপক্ষে।
পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি, তাহলে পূরণ হবে কীভাবে। এই জবাব খোঁজার আগে চলতি বাজেটের ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণের উপায়গুলো মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।
চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৭৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুরো অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। যদিও ছয় মাসেই সরকার ৫৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে।
আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ মাসে সরকার সংগ্রহ করেছে ৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। ধরে নেওয়া যায় যে করোনাভাইরাসের প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে আরও ভাটা হবে এবং ব্যাংক ঋণ বাড়বে আরও।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সবকিছুর মূলে হচ্ছে রাজস্ব ঘাটতি। আগে থেকেই রাজস্ব সংগ্রহের হার কম ছিল। এখন তা কত কম হবে, অনুমান করাই মুশকিল।
এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ৬০ শতাংশের বেশি হবে না অনুমান করে আহসান মনসুর বলেন, ‘এ থেকে ভালো একটা টাকা বেঁচে যাবে। আর যা বুঝতে পারছি, কর্মসংস্থানকে সরিয়ে রাখলেও সাধারণ খরচের জন্যই ব্যাংক থেকে সরকারকে ধার করতে হতে পারে এক লাখ কোটি টাকার মতো। কিন্তু এ টাকায়ও কুলাবে বলে মনে হয় না। সঞ্চয়পত্র থেকে যেহেতু বেশি টাকা আসবে না, শেষ পর্যন্ত টাকা ছাপানোর পথে সরকারকে যেতেই হবে।’