নিজেদের তৈরি নিয়ম নিজেরাই ভেঙেছে ভিকারুননিসা স্কুল

শিক্ষা অধিদপ্তর ও স্কুল কর্তৃপক্ষের পালটাপালটি দোষারোপ

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : চলতি বছর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণিতে ‘নিজেদের জারি করা নিয়ম ভেঙে’ ১৬৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। একপর্যায়ে এসব শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করার জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আর এমন নির্দেশনা পেয়ে ভর্তি বাতিল করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে ভর্তি বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরাও আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। শিশু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা মানববন্ধনও করছেন।

বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভিকারুন নিসায় বারবার ভর্তি নিয়ে এত বিতর্ক কেন? কেনই বা আবারও ভিকারুন নিসা কর্তৃপক্ষ নিজেদের জারি করা নোটিশ নিজেরাই অমান্য করল।

দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ ও বিভিন্ন কেনাকাটায় অনিয়ম চলছিল। এসব অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে সবকিছু দেখভাল করতে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি হন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম। এছাড়া গভর্নিং বডিতে সরকারি বেশ কয়েক জন কর্মকর্তাও রয়েছেন। অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে রক্ষা পেতে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো। এর পরও কেন বিতর্ক?

যে কারণে ভর্তি বাতিল ও বিতর্ক : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর বয়স ৬+ বছর হতে হবে। আর শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, শিক্ষার্থীর বয়সের ঊর্ধ্বসীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। সেই আলোকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ গত ১৯ অক্টোবর ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে প্রথম শ্রেণিতে বয়সসীমা নির্ধারণে জন্ম তারিখ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঐ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। ঐ ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের আগে জন্মগ্রহণকারী কোনো শিক্ষার্থী ভিকারুন নিসায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না।

কিন্তু দেখা যায়, ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বরের আগে জন্মগ্রহণকারী ১৬৯ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। এসব শিক্ষার্থী ক্লাসও শুরু করে। বিষয়টি জানাজানি হলে এই ভর্তি বাতিলের জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন এক অভিভাবক। একপর্যায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এই ভর্তি বাতিল করে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলের প্রশ্নে রুল দুই মাসে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ।

কী বলছে ভিকারুন নিসার ভর্তি কমিটি : ভিকারুন নিসায় ভর্তির জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রধান প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি শাখার প্রধান মাহমুদ আহমেদ। এই কমিটিতে বিভিন্ন শাখাপ্রধান ও শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন। মাহমুদ আহমেদ বলেন, এসব শিক্ষার্থী ভর্তির আগে আমরা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বেলাল আহমেদ, উপপরিচালক আজিজ উদ্দিন এবং সহকারী পরিচালক এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের কাছে ভর্তির বিষয়ে নির্দেশনা চাইলে তারা আমাদের এসব শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য পরামর্শ দেন।

মাহমুদ আহমেদ বলেন, ‘মাউশির এই কর্মকর্তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষার্থীর বয়স ১৪ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত। সে কারণে এসব শিক্ষার্থী ভর্তিতে বাধা কোথায়? এছাড়া আমরা গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনিও আমাদের ভর্তি করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ কারণে ভর্তি করেছি। তবে মাউশির কর্মকর্তারা কোনো লিখিত আদেশ দেননি, মৌখিক পরামর্শ দিয়েছেন।

ভর্তিতে সায় ছিল গভর্নিং বডির : শিক্ষকেরা যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, তখন গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরীসহ ভর্তি কমিটির সদস্যরা দেখা করেন। এ বিষয়ে গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সভাপতি আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কলেজ থেকে বয়সের ঊর্ধ্বসীমার যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরে দেওয়া হয়েছে কি না। এর জবাবে সবাই জানান, ওয়েবসাইট ছাড়া কোথাও দেওয়া হয়নি। তখন তিনি বলেন, ওয়েবসাইটে আর কত জন দেখবে? তখন তিনি ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন।

কী বলছে মাউশি : এ বিষয়ে মাউশির তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন ও উপপরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। বেলাল হোসাইন বলেন, ‘এসব শিক্ষার্থী ভর্তিতে আমরা কোনো পরামর্শ দিইনি। এটা তারা মিথ্যা কথা বলছেন।’ আজিজ উদ্দিন বলেন, ‘সারা দেশের ভর্তি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি, শুধু ভিকারুন নিসায় হয়েছে। তারা বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আবার সেটা তারাই ভঙ্গ করেছেন। আমরা ১৬৯ শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য কোনো পরামর্শ বা নির্দেশনা দিইনি। নিজেরা বাঁচতে তারা এখন মাউশিকে দোষারোপ করছে। আমার মনে হয়, তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে।’

ফিল্টারিং করার সুযোগ ছিল না : সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার আলোকে সফটওয়্যারে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা না থাকার কারণে বয়সের আলাদা ফিল্টারিং করার সুযোগ ছিল না। ঐ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের অভ্যন্তরীণ ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে বয়সের সীমা নির্ধারণ করে দিলেও টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে লটারি অনুষ্ঠান আয়োজনের আগে বিষয়টি দাপ্তরিকভাবে অবহিত করেনি।

ঊর্ধ্বসীমার নোটিশ জারি করেছেন অধ্যক্ষ নিজেই : মাউশির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে বয়সের ঊর্ধ্বসীমার নোটিশ দেয়নি, কিন্তু ভিকারুন নিসার অধ্যক্ষ নোটিশ জারি করেই ভুল করেছেন। আর নিজের নোটিশের আদেশ নিজেই ভেঙেছেন। একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলা হলে তারাও স্বীকার করেন, অধ্যক্ষ নিজেই এই নোটিশ ওয়েবসাইটে দিয়েছেন। ভর্তি কমিটির এক সদস্য জানান, নোটিশ জারির কথা আমিও জানতাম না। বাছাই করতে গিয়েই শুনেছি, তিনি নাকি এমন নোটিশ জারি করেছেন। তবে এ বিষয়ে অধ্যক্ষের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

Share