নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন

আপাতত থাকবেন ভারতে

বিশেষ প্রতিবেদক: নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন। তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে ফের এই নতুন বার্তা দিয়েছেন। ততদিন সম্ভবত শেখ হাসিনা ভারতে থাকবেন। কারণ, তাঁর যুক্তরাজ্য যাওয়ার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ‘প্রয়োগিক বাধা’ (টেকনিক্যাল) রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ৫ আগস্ট গণবিক্ষোভের মুখে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বার্তাসংস্থা রয়টার্স এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের পৃথক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরেছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিন আগেই জয় বলেছিলেন, যখন বাংলাদেশে আবার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে তখনই তিনি (হাসিনা) ফিরে আসবেন। যদিও জয় এর আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, হাসিনা আর কখনোই দেশে ফিরবেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন তার ছেলে। কয়েক সপ্তাহের মারাত্মক বিক্ষোভের পর হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হয়ে গত সোমবার প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান। এরপর নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৃহস্পতিবার শপথ গ্রহণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপালন করবে।

রয়টার্স বলছে, হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাথে কথা বলেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আপাতত তিনি (হাসিনা) ভারতে আছেন। অন্তর্র্বতী সরকার যখনই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেবে তখনই তিনি বাংলাদেশে ফিরে যাবেন।’

উল্লেখ্য, চাকরির কোটা নিয়ে কয়েক সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভে ৪০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হওয়ার পর গত সোমবার ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাকে ৪৫ মিনিটের আলটিমেটাম দেওয়ার পর তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। সেখান থেকে সম্ভবত যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিতে তিনি লন্ডনে যাবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় না দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের যে অভিবাসন আইন রয়েছে; সেখানে কোনো ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করে এসে রাজনৈতিক বা সাধারণ আশ্রয় নেওয়ার বিধান নেই।
এছাড়া কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনার ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিসা যুক্তরাষ্ট্র বাতিল করেছে বলে নিশ্চিত করেছে। রয়টার্স বলছে, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর হাসিনা বর্তমানে নয়াদিল্লি এলাকায় একটি সেফ হাউসে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতীয় মিডিয়া জানিয়েছে, তিনি ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তবে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বলেছেন, তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলেছেন। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। জয় বলেছেন, প্রয়োজন হলে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন না তিনি। তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে এবং আমরা জয়ীও হতে পারি।
শেখ হাসিনা আপাতত দিল্লিতে থাকছেন: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট সোমবার শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বোন আছেন। যুক্তরাজ্যে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা থাকেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

তবে যুক্তরাজ্যের অভিবাসনবিধি অনুসারে, একজন ব্যক্তি যুক্তরাজ্যে থাকলেই কেবল তাঁর আশ্রয়ের অনুরোধ বিবেচনায় নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। তা ছাড়া যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনার ভিসাও নেই।
অন্যদিকে আশ্রয়প্রার্থীর বিষয়ে সরকারি নীতি না থাকা সত্ত্বেও ভারত শেখ হাসিনাকে থাকতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে কী আচরণ করা উচিত, সেই প্রশ্ন অতীতেও উঠেছে। অতি সম্প্রতি, বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশের কারণে এই প্রশ্ন উঠেছে।

আশ্রয়প্রার্থী/শরণার্থী কে: ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকল অনুযায়ী, শরণার্থী শব্দটি এমন ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, যিনি নিজ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এবং জাতিগত, ধর্মীয়, জাতীয়তা, একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য বা রাজনৈতিক মতামতের জন্য নিপীড়নের বিশ্বাসযোগ্যে ভয়ের কারণে দেশে ফিরে যেতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিরাও এই অর্থে শরণার্থী হতে পারেন।
জাতিসংঘ বলেছে, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক দমন অভিযানের পর রোহিঙ্গাদের পলায়ন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের কক্সবাজার এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির। মিয়ানমারের দাবি, রোহিঙ্গারা, যাঁরা প্রধানত মুসলিম, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী।
ভারতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এই রোহিঙ্গাদের বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া অস্পষ্ট।

ভারত সরকার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচসিআর) যাচাই-বাছাই করা ও কয়েকজনকে পরিচয়পত্র দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে দেশটির সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা এই রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক অপবাদ নিয়ে জনসাধারণ ও রাজনৈতিক বক্তব্য মিলিয়ে তাদের অবিলম্বে দেশ থেকে ‘বহিষ্কার’ করার দাবি উঠেছে।

ভারত ও জাতিসংঘের সনদ: ভারত অতীতে শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে। প্রায় ৩ লাখ লোককে শরণার্থী হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিব্বতি, বাংলাদেশের চাকমা, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উদ্বাস্তুরা।
কিন্তু ভারত ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ সনদ বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। ভারতের শরণার্থীনীতি বা শরণার্থী আইনও নেই।

এই বিষয়টি শরণার্থী প্রশ্নে করণীয় নির্ধারণে বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ ভারতের সামনে উন্মুক্ত রেখেছে। সরকার যেকোনো শরণার্থীকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। যেমনটি হয়েছে ইউএনএইচসিআরের যাচাই-বাছাই সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। বিদেশি সম্পর্কিত আইন বা ভারতীয় পাসপোর্ট আইনের আওতায় তাঁদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার।

শরণার্থীনীতির ক্ষেত্রে ভারতের নেওয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হলো নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (২০১৯)। আইনটিতে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে শরণার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

নির্বাসন, নন-রিফুলমেন্ট: ২০২১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের এই যুক্তিকে মেনে নেয় যে, দেশটিতে রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী। সে সময় সুপ্রিম কোর্ট ৩০০ রোহিঙ্গা সদস্যের মুক্তির আদেশ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, যাঁদের বেশির ভাগই জম্মুতে একটি আটকশিবিরে ছিলেন। আর অন্যরা ছিলেন দিল্লিতে। আদালত বলেন, বিদেশি আইন, ১৯৪৬-এর আওতায় তাঁদের নির্বাসিত করা উচিত।

তবে এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিষয়টি যে জটিল, তা ২০২১ সালে আসাম সরকারের ১৪ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা কিশোরীকে ফেরত পাঠানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা থেকে স্পষ্ট হয়। কিশোরীটি বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে থাকা তার বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। ২০১৯ সালে আসামে ঢোকার সময় তাকে আটক করা হয়েছিল। মিয়ানমারে তার পরিবারের কোনো সদস্য আর ছিলেন না। কিন্তু আসামের কর্মকর্তারা তাকে নির্বাসনের জন্য মণিপুরের সীমান্তে নিয়ে যায়। তবে মিয়ানমার তাকে ফেরত নেয়নি।

আইনগত নির্বাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সীমান্ত দিয়ে পুশ-ব্যাক করা যাবে না। অন্য দেশকে অবশ্যই নির্বাসিত ব্যক্তিকে তার দেশের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে রাজি করাতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। তবে ভারত অনেক কষ্টে মুষ্টিমেয় রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে।

কিন্তু ভারতে রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে তাদের শরণার্থী বলে বাংলাদেশ। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চেয়ে ভারত ‘নন-রিফুলমেন্ট’ নীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এই নীতি মানতে ভারতের বাধ্যবাধকতা আছে।

‘নন-রিফুলমেন্ট’ মানে কোনো শরণার্থীকে কোনোভাবেই কোনো দেশে ফেরত পাঠানো হবে না, যেখানে তাঁর ওপর নিপীড়নের ঝুঁকি থাকবে।

ভারত কীভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে, তা শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের অনেকেই তামিলনাড়ুর শিবিরে আছেন।

তামিলনাড়ু রাজ্য সরকার তাদের (তামিল শরণার্থী) একটি ভাতা দেয়। তাঁদের চাকরি খুঁজতে সুযোগ দেয়। তাঁদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর ভারত স্বেচ্ছা-প্রত্যাবাসন পদ্ধতির মাধ্যমে দেশে ফেরাকে উৎসাহিত করে। তাঁরা ইউএনএইচসিআরের মতো জাতিসংঘের সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেশে ফেরা নিরাপদ কি না। এই পদ্ধতিটি ‘নন-রিফুলমেন্ট’-এর নীতি মেনে চলে।

ইউএনএইচসিআর বলছে, স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করাটা তার অগ্রাধিকার। পাশাপাশি প্রত্যাবর্তনকারীদের সহায়তা করাও অগ্রাধিকার। এর অর্থ, নিজ জনগণকে পুনর্মিলনে সহায়তার জন্য মূল দেশের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি।

Share