নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম চিকিৎসা। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ চাহিদা থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে দেশের কিছু অসাধু চিকিৎসক, ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানি এমনকি হাসপাতালও। এদিকে দেশের ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে শীর্ষ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি।
এরা সহ অন্যান্যরা বিপণনে ব্যয় করছে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা। নগদ অর্থ, ওষুধ বা অন্যান্য উপহার হিসেবে এর উল্লেখযোগ্য অংশ যাচ্ছে চিকিৎসকদের পকেটে।
চিকিৎসক প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র চিকিৎসাপদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেখানে উল্লেখ থাকে রোগীর প্রতি দিক-নির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ। যা লেখার রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক নির্দেশনা রয়েছে চিকিৎসাপত্রে ওষুধের ‘জেনেরিক নাম’ উল্লেখ করতে হবে, কোনো ‘ব্র্যান্ড নাম’ উল্লেখ করা যাবে না।
অথচ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় চিকিৎসক ওই কোম্পানির ওষুধের ‘ব্র্যান্ড নাম’ চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন দেশের চিকিৎসকরা। জানা গেছে, মূলত প্রলুব্ধ হয়ে ৯০ শতাংশ চিকিৎসকই ব্যবস্থাপত্রে পছন্দের কোম্পানির ওষুধের বাণিজ্যিক নাম লিখে দিচ্ছেন। যার বিনিময়ে নগদ অর্থ, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, ওষুধ বা অন্যান্য উপহার হিসেবে এর উল্লেখযোগ্য অংশ যাচ্ছে চিকিৎসকের পকেটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ফিজিশিয়ান প্র্যাকটিস ম্যানুয়ালে বলা আছে, চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে বিশেষ কোনো ব্র্যান্ড বা কোম্পানির ওষুধের নাম লিখতে পারবেন না, যা রোগীর জন্য ব্যয়বহুল। পাশাপাশি সহজলভ্য ও দাম তুলনামূলক কম, এমন ওষুধ লেখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে ম্যানুয়ালে। যদিও এসব নির্দেশনার কোনটিই মানছেন না দেশের চিকিৎসকরা। ফলে অনেক মানুষই প্রশ্ন করছে ডাক্তার তুমি কার! অথচ এনিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার মাথা ব্যথা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব (নাম প্রকাশ না করা শর্তে) বলেন, ‘ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন সংশোধনের প্রয়োজন। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আইনটি হয়ে গেলে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকরা নিজেদের পছন্দসই বা কোন নির্দিষ্ট ব্রান্ডের ওষুধের নাম লিখতে পারবে না।’
ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ২৫৭টি অনুমোদিত কোম্পানির মধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ১৫০টি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ইবিএল সিকিউটিরিজের ওষুধশিল্প খাত নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওষুধশিল্পের বাজার ২০ হাজার ৫১১ কোটি টাকার। গত পাঁচ বছরে এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০টি জেনেরিকের। এগুলো বিক্রি হয় ২৫ হাজার ব্র্যান্ড নামে। দেশে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, অপসোনিন, এসকেএফ, রেনাটা, একমি, এসিআইসহ শীর্ষ ১০ কোম্পানি। ‘সিপ্রোফ্লোক্সাসিন’ বহুল ব্যবহৃত একটি অ্যান্টিবায়োটিকের জেনেরিক নাম। ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড নামে কোম্পানিগুলো এটি বাজারজাত করছে। স্কয়ার ফার্মা এটি বিপণন করছে সিপ্রোসিন, বেক্সিমকো নিওফ্লক্সিন, ইনসেপ্টা বিউফ্লক্স ও একমি ল্যাবরেটরিজ সিপ্রো-এ নামে।
বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩ সালের তথ্য মতে, দেশে ওষুধ বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ শীর্ষ ১০ কোম্পানির হাতে। গত বছর এ বাজারের ১৯ শতাংশের দখল ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের। এছাড়া ইনসেপ্টার নিয়ন্ত্রণে ছিল ৯ শতাংশ, বেক্সিমকোর ৮ দশমিক ৬২, অপসোনিনের ৪ দশমিক ৯৪, এসকেএফের ৪ দশমিক ৮৪, রেনাটার ৪ দশমিক ৭৩, একমির ৪ দশমিক ৪৪, এসিআইয়ের ৪ দশমিক শূন্য ৮, অ্যারিস্টোফার্মার ৪ ও ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল বলছে, ডব্লিউএইচও,র নির্দেশনা মেনে ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা হলে অপেক্ষাকৃত কম দামে ওষুধ কিনতে পারত রোগীরা। ওষুধ প্রাপ্তিও সহজ হতো। কিন্তু বাণিজ্যিক নাম লিখে ভোক্তার স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। একই মানের ওষুধ তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া জেনেরিক নাম লেখা হলে চিকিৎসককে প্রলুব্ধ করার বিষয়টিও বন্ধ হতো।
এসব বিবেচনায় ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার দাবি জানিয়ে আসছে কাউন্সিল। দুই দশক ধরে তারা এ দাবি জানিয়ে এলেও সরকার এ ব্যাপারে কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। ফলে চিকিৎসকরাও সেই সনাতন ধারায় পছন্দের কোম্পানির ওষুধের ব্র্যান্ড নাম ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিচ্ছেন।
অপরদিকে বিশ্বের অনেক দেশেই ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনা মেনে ব্যবস্থাপত্রে বাণিজ্যিকের পরিবর্তে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখছেন চিকিৎসকরা। যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকরা ৮০ শতাংশ ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ হার ৬৬ ও ইউরোপে ৫০ শতাংশ।
চিকিৎসাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার আগে মান নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান জানান, ‘দেশে ওষুধ উৎপাদনকারী কয়েক’শ কোম্পানি থাকলেও গুণগত মান ঠিক রাখছে মাত্র কয়েকটি। তাই জেনেরিক নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আগে সব কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের মান শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় জেনেরিক নাম বাধ্যতামূলক করা হলে কম দামি ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি বেড়ে যাবে। এতে প্রতারিত হবে ক্রেতা।’