নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : দৈনিক শ্রম সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বেই শ্রমিক সংহতি দিবস বা ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হয়। কিন্তু দেশের শ্রম খাতে মৌলিক এ দুটি দাবির কোনোটাই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি আজও। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১০২টি প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের অন্তত ৬২টিতে ঘোষিত নূ্যনতম মজুরি নেই। যেসব শিল্পে ঘোষিত মজুরি আছে, সেখানেও মজুরি কাঠামো পরিপূর্ণভাবে মানা হয় না। ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে মজুরি এবং শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অন্যদিকে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টার শ্রমসূচি মানা হয় না বেশিরভাগ শিল্পে। অতিরিক্ত সময় শ্রম বা ওভারটাইম করতে বাধ্য হন শ্রমিকরা। এই ওভার টাইমের মজুরি নিয়েও আছে টালবাহানার অভিযোগ।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) থেকে দেশের সব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নিতে হয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থা এ পর্যন্ত ৫৪টি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। এর বাইরে বিবিধ তালিকায় আরও অন্তত ৫০টি শিল্প খাতকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এই ১০২টি শিল্পের মধ্যে মজুরি বোর্ড মাত্র ৪২টি শিল্পে নূ্যনতম মজুরি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ এখনও বাকি ৬২টি শিল্পের শ্রমিকরা নূ্যনতম ঘোষিত মজুরির বাইরে রয়েছেন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ছয় কোটি ৭০ হাজার মানুষ শ্রমবাজারে নিয়োজিত। এই জনশক্তির মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে ৮৯ দশমিক ৯ এবং বাকি ১০ দশমিক ১ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। একইভাবে সেবা খাতে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, বাকি ২৯ দশমিক ২ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা কোনো কাঠামোর মধ্যে না থাকায় শ্রম অধিকার কিংবা মজুরি বোর্ডের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নিয়োগকর্তা বা মালিকের খেয়ালখুশিতেই এসব খাতের শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা ঘোরে।
শ্রম পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় ডিআইএফই-এর পরিদর্শন প্রতিবেদনে। সারাদেশের কারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত এবং বিশেষ পরিদর্শন করে থাকেন সংস্থার কর্মকর্তারা। ডিআইএফই-এর সর্বশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে, এখনও মজুরি হয় না ২ শতাংশ পোশাক কারখানায়। মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির চেয়ে কম দেয় ৪ শতাংশ কারখানা। ওভারটাইম দেওয়া হয় না ৫ শতাংশ কারখানায়। মাতৃকালীন ছুটি নেই ১২ শতাংশ কারখানায় ও শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না ১২ শতাংশ কারখানায়। শ্রম-সংক্রান্ত এরকম কোনো না কোনো ত্রুটি পাওয়া গেছে প্রায় সব কারখানায়। মাত্র এক হাজার ৫৫০ পোশাক কারখানা পরিদর্শনে এই অনিয়ম পাওয়া গেছে। পোশাক খাতে নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। এর মধ্যে নিয়মিত উৎপাদনে আছে সাড়ে তিন হাজারের মতো। তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য শিল্পের পরিস্থিতিও অভিন্ন। শ্রম অধিকারের প্রশ্নে এ রকম অনিয়মের অভিযোগে গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) ৪৩ হাজার পরিদর্শন থেকে এক হাজার ৬৮৯টি মামলা করা হয়েছে ডিআইএফই-এর পক্ষ থেকে। তবে বড় শিল্প হিসেবে পোশাক কারখানার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সবচয়ে কম মাত্র ৬৯টি। সবচেয়ে বেশি ৮৮২টি মামলা হয়েছে পোশাক-বহির্ভূত অন্যান্য কারখানার বিরুদ্ধে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সমকালকে বলেন, মে দিবসের মূল চেতনা ছিল আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করা। এই আট ঘণ্টার কাজ দিয়ে একজন শ্রমিক পরিবার নিয়ে সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রমিকদের ওপর আট ঘণ্টার জায়গায় ১২ ঘণ্টা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ১২ ঘণ্টার আয় দিয়েও একজন শ্রমিক নিজেই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন না। এর পরও ওভারটাইমের অর্থ নিয়ে চলে টালবাহানা।
নূ্যনতম মজুরি মাত্র ৭৯২ টাকা :মজুরি বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, কোনো কোনো শিল্পে ঘোষিত মজুরিও বিস্ময়কর এবং অমানবিকভাবে কম। যেমন- পেট্রোলপাম্পের একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি সাকুল্যে মাত্র ৭৯২ টাকা। এই মজুরির মধ্যেই যাতায়াত ভাতা ২০ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া ১১২ টাকা। এ রকম উদ্ভট হারে মজুরি নির্ধারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পেট্রোল পাম্প শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি পর্যালোচনার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। তবে বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি একপর্যায়ে পদত্যাগ করেন। তখন থেকেই সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকেও আর কোনো নির্দেশনা পাননি তারা। তিনি জানান, সরকার যেসব পেশার মজুরি বোর্ড গঠনের জন্য তাদের নির্দেশ দেয়, তারা কেবল সে বোর্ড নিয়েই কাজ করতে পারেন।
শ্রম আইনে প্রতি পাঁচ বছর পর পর মজুরি পর্যালোচনার বিধান আছে। পেট্রোলপাম্প শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৩২ বছর আগে ১৯৮৭ সালে। এ প্রসঙ্গে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, মজুরি বোর্ড নিজস্ব উদ্যোগে কোনো পেশার মজুরি নির্ধারণ কিংবা পর্যালোচনা করতে পারে না। প্লাস্টিক, রি-রোলিং ও রাইস মিল- এই তিনটি শিল্পের মজুরি নির্ধারণের কাজ চলছে বলে জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একমাত্র তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য কোনো শিল্পে আইন অনুযায়ী নিয়মিত মজুরি পর্যালোচনা হয় না।
শ্রম নিরাপত্তা বেড়েছে পোশাক খাতে :রানা প্লাজা ধস এবং তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনার পর পোশাক খাতের কর্ম-পরিবেশের নিরাপত্তা উন্নয়নে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোগের ফলে এ খাতে গত ছয় বছরে নজরে আসার মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি। ২০১৮ সালে অন্যান্য বছরের তুলনায় দুর্ঘটনার হার ছিল সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক জরিপ মতে, গত বছর পোশাক খাতে দুর্ঘটনায় তিন শ্রমিক নিহত এবং ১৮ জন আহত হন। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনার হার কমলেও এ সময় শ্রমিকদের ওপর সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। ১১০টি সহিংসতার মধ্যে ২৬টি নির্যাতন, ২১টি হত্যা, ১১টি ধর্ষণ ও ৯টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে ১২৩টি। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ২৯৮ শ্রমিক। শুধু বকেয়ার দাবিতে ৫৪টি শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া শ্রমিকের মৃত্যু, বিনা নোটিশে কারখানা বন্ধ, ন্যায্য মজুরি ও শ্রম অধিকারের দাবিতে এসব অসন্তোষ হয়েছে।
বিলসের জরিপের তথ্য, ২০১৮ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় এক হাজার ২০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে ১০০২ জন পুরুষ বাকি ১৮ জন নারী। খাতওয়ারি সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা পরিবহন খাতে- ৪২৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬১ জন নির্মাণ খাতে। কৃষি খাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১৪ জন শ্রমিক নিহত হন।
আবাসন রেশনের দাবি উপেক্ষিত :শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যে চাল, ডাল, তেল ও চিনির মতো নিত্যপণ্যের রেশনের দাবি দীর্ঘদিনের। প্রতি বছরই বাজেট পেশের আগে এ রকম দাবি তোলা হয় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। তবে কারখানা মালিক কিংবা সরকার কোনো পক্ষই এ দাবি আমলে নেয়নি। জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সমকালকে বলেন, এই দাবি কেউ আমলে নিচ্ছে না। অথচ কারখানার সামনে রেশনে নিত্যপণ্য পাওয়া গেলে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বেঁচে যেত। তিনি বলেন, বিজিএমইএর পুরনো ভবনটি না ভেঙে শ্রমিকদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করলে ভবনটির সর্বোত্তম ব্যবহার হতো। চিকিৎসাবঞ্চিত শ্রমিকরাও চিকিৎসা সেবা পেতেন। মে দিবস উপলক্ষে দেশের লাখ লাখ শ্রমিকের পক্ষে সরকারের কাছে এই দাবি জানান তিনি। অন্যদিকে মজুরি বাড়লেই অনিবার্যভাবে বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায় শ্রমিকদের। ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতির কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। এ কারণে মজুরির বড় একটি অংশই ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়ার পেছনে। শ্রমিকদের আবাসন সংকটের সমাধানে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোর পতিত জমিতে আবাসন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। এ প্রকল্পের অধীনে নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে ছয়তলা করে কয়েকটি ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়। এসব ভবনে শ্রমিকরা কম খরচে ভাড়া থাকবেন। তবে এই প্রকল্প এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
মুনাফা শেয়ার করেন না মালিকরা :’বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন’ অনুযায়ী মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয়ের অংশ হিসেবে সরকারের শ্রম কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনটি সংশোধন এবং বিধিমালা জারির পর গত পাঁচ বছরে মাত্র ১২২টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি এই তহবিলে অর্থ জমা দিয়েছে। দেশে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মস নিবন্ধকের কার্যালয়ে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা এখন দেড় লাখ। অর্থাৎ বাকি প্রতিষ্ঠান এই তহবিলে অর্থ জমা দেয়নি। শ্রম আইন অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাত এই তহবিলে যুক্ত নয়। শতভাগ রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের জন্য কেন্দ্রীয় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল নামে আলাদা একটি তহবিল চালু রয়েছে। ওই তহবিলের অর্থ পোশাক শ্রমিকদের মৃত্যু বীমাসহ অন্যান্য কল্যাণে ব্যয় করা হয়।