নিজস্ব ডেস্ক প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরীক্ষামূলক ওষুধ রেমডেসিভির নিয়ে আশার কথা শোনালেন মার্কিন গবেষকেরা। ওষুধটি নিয়ে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে ৩০ শতাংশ দ্রুত সেরে উঠছে রোগী। বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, নতুন রোগের ক্ষেত্রে সফল চিকিৎসার প্রথম প্রমাণ এটি।
সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য চিকিৎসায় গতকাল বুধবার কিছুটা সুখবর দিয়েছেন গবেষকেরা। পরীক্ষামূলক ওষুধ রেমডেসিভির দ্রুত সংক্রমণ থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করতে পারে বলে প্রমাণ মিলেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য কোনো ওষুধের অনুমোদন দেয়নি। তবে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এফডিএ। জ্যেষ্ঠ এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, বুধবার নাগাদ অনুমোদনের ঘোষণা আসতে পারে।
সিএনএনকে এফডিএ বলেছে, তারা রেমডেসিভিরের প্রস্তুতকারক গিলিয়াড সায়েন্সেসের সঙ্গে রোগীকে দেওয়ার জন্য ওষুধ তৈরির বিষয়ে আলোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রেমডেসিভির পাওয়া রোগীরা সাধারণ রোগীর তুলনায় দ্রুত সেরে উঠেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্থনি এস ফাউসি ইতিবাচক ফলাফলের ব্যাপারে আগে থেকেই আশাবাদী ছিলেন। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক আলোচনায় ফাউসি গতকাল বলেছেন, তথ্য বলছে, করোনা থেকে দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে রেমডেসিভিরের ইতিবাচক প্রভাব পরিষ্কার।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, রেমডেসিভির প্রয়োগে সেরে ওঠার সময় ১৫ দিন থেকে ১১ দিনে নেমে এসেছে। সাধারণ ফ্লুর ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধ তামিফ্লু যে প্রভাব ফেলেছে, এটি তার অনুরূপ। রেমডেসিভির সম্পর্কে ফাউসি বলেন, ‘শতভাগ উন্নতির জায়গায় ৩১ শতাংশ যদিও খুব বেশি নয়, তবু এটা ধারণার খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এটি রোগীর মারা যাওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করতে পারে।’
আগে প্রাথমিক পরীক্ষায় সাধারণত ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করা হতো না। তবে ফাউসি বলেন, ওষুধ যেহেতু কাজ করছে বলে পরিষ্কার প্রমাণ মিলেছে, তখন তা দ্রুত মানুষকে জানানো নৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিস মেডিকেল সেন্টারের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জর্জ থম্পসনের ভাষ্য, এই ওষুধ ‘আইভি’ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে সরাসরি রক্তে প্রবেশ করানো হয়। এটি শরীরে থাকা ‘আরএনএ পলিমেরাজ’ নামের একটি এনজাইম বিকল করে দেয়। অনেক ভাইরাস নিজেদের অনুলিপি তৈরি করতে এই এনজাইম ব্যবহার করে। রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকেরা কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই এই প্রতিষেধক ব্যবহারের জন্য এফডিএর কাছ থেকে বিশেষ বিবেচনায় ব্যবহারের অনুমতি পেতে সক্ষম হন। ‘রেমডেসিভির’র ক্ষেত্রে আরও পরীক্ষা করা দরকার।
কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যে কয়েকটি ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা চলছে, তার মধ্যে রেমডেসিভির এফডিএর অনুমোদনের লক্ষ্য নিয়ে নিয়ম অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। এতে আন্তর্জাতিকভাবে ১ হাজার ৯০ জন অংশ নেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রেমডেসিভির পরীক্ষার ফল নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে চায়নি। করোনার প্রতিক্রিয়া দলের কারিগরিপ্রধান ড. মারিয়া ভ্যান কেরখভ বলেছেন, ‘সাধারণত, আপনার কাছে এমন একটি গবেষণা নেই, যা প্রকাশিত হয়ে একটি গেম চেঞ্জার হয়ে উঠবে। সংস্থাটি সাধারণত পর্যালোচনা ও প্রমাণের সমালোচনা করার আগে বেশ কয়েকটি গবেষণা থেকে প্রমাণ একত্র করে।’
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পেছনে থাকা প্রধান ড. আন্দ্রে কালির গতকাল সিএনএনকে বলেন, কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে এ ওষুধ গল্পের শেষ নয়। আরও কাজ করতে হবে। অন্য চিকিৎসা খুঁজতে হবে। এ পরীক্ষাও চলবে। তিনি মনে করেন, ‘হাসপাতালে কম দিন থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। বেশি দিন থাকলে জটিলতা বাড়ে।’
গতকাল ওষুধের একটি পৃথক পরীক্ষা থেকে গিলিয়েড সায়েন্সেস নিজস্ব অনুসন্ধান প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, যারা ৫ দিন এটা নিয়েছে, তারা ১০ দিন নেওয়াদের মতোই ভালো করেছে। তবে পরীক্ষায় ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য এটি কার্যকর কি না, তা দেখা হয়নি। আরও প্রমাণ হাজির করতে হবে। মারাত্মক অবস্থায় থাকা ৩৯৭ জন রোগীকে নিয়ে এ পরীক্ষা চালানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ৫ দিন নাকি ১০ দিন এটি ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কিত।’
স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত মার্কিন ওয়েবসাইট স্ট্যাট নিউজ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো হাসপাতালে গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের গিলিয়াড সায়েন্সেসের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। নিবিড়ভাবে এ ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পর্যবেক্ষণে রোগী জ্বর ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণগুলো থেকে দ্রুত সেরে ওঠার এবং এক সপ্তাহের কম সময়ে সব রোগীকে ছেড়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ওই পরীক্ষায় রেমডেসিভির নিয়ে ৫ দিন ও ১০ দিনের চিকিৎসার দুটি উপায় খোঁজ করা হচ্ছিল। এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দুটি চিকিৎসা উপায়ের মধ্যে রোগীর উন্নতির পরিসংখ্যানগত তুলনা করা। সাত পয়েন্টের স্কেল ধরে উন্নতি মাপা হচ্ছিল যে স্কেলের সবচেয়ে খারাপ পয়েন্ট ছিল মৃত্যু আর সবচেয়ে ভালো ফল ছিল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়ও স্কেলে ছিল। তবে এ গবেষণার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ঘাটতি ফলাফল ব্যাখ্যা করা বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জিং করতে পারে।
রেমডেসিভির নিয়ে বিশ্বের ১৫২টি স্থানে গুরুতর উপসর্গ রয়েছে, এমন ২ হাজার ৪০০ রোগীর ওপর ওষুধটির পরীক্ষা চলছে। এ ছাড়া বিশ্বের ১৬৯টি হাসপাতালে মধ্যম পর্যায়ের উপসর্গ রয়েছে, এমন ১ হাজার ৬০০ রোগীর মধ্যেও ওষুধটির পরীক্ষা হচ্ছে।
গিলিয়াড সায়েন্সেসের তৈরি করা ওষুধ রেমডেসিভির এর আগে ইবোলা চিকিৎসায় প্রয়োগ করে কিছুটা সাফল্য এসেছিল। তবে কোভিড-১৯ রোগের কারণ যে করোনাভাইরাস, সেই গোত্রের ভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় এটি এর আগে ভালো সাফল্য দেখিয়েছে। বিশেষত অন্য প্রাণীর শরীরে ওষুধটির প্রয়োগ করে বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পান। গত ফেব্রুয়ারিতে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় রেমডেসিভিরকে সম্ভাব্য ওষুধ হিসেবে উল্লেখ করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
এএফপির প্রতিবেদন বলছে, গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক ছোট আকারের পরীক্ষা ও ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে রেমডেসিভির অকার্যকর বলে জানা গিয়েছিল। এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে উৎপত্তি হওয়া কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও রেমডেসিভিরের সীমিত প্রভাব দেখা গিয়েছিল।
এদিকে নেচারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ সৃষ্টির জন্য দায়ী নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২-কে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা হিসেবে পরীক্ষাগারে চিহ্নিত প্রথম ওষুধগুলোর মধ্যে একটি ছিল রেমডেসিভির। সাংঘর্ষিক তথ্য পাওয়া গেলেও বৃহত্তম পরীক্ষার ফলাফলের হিসেবে দ্রুত সেরা ওঠার চিকিত্সাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত্নের মান হিসেবে গড়ে তুলবে।
রেমডেসিভির বর্তমান মহামারির জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসসহ কিছু ভাইরাসের প্রতিরূপ তৈরিতে হস্তক্ষেপ করে। কয়েক সপ্তাহের তথ্য ফাঁস হওয়ার পরে এবং ড্রাগের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর মিশ্র ফলাফলের এক দিনের পরে সংবাদটি এল। চীনের ছোট এক পরীক্ষার এটা কার্যকর হয়নি বলে জানা যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রে বড় আকারের নিয়ন্ত্রিত এ পরীক্ষা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন।
ফেব্রুয়ারিতে গবেষকেরা দেখিয়েছিলেন যে ওষুধটি একটি পরীক্ষাগারে জন্মানো মানবকোষে ভাইরাল সংক্রমণ হ্রাস করে।
বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে বলেছে, এটি এমন সময় এল, যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কমিটি তিন মাসের মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো কোভিড–১৯ মহামারির বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে চলেছে, যা বিশ্বব্যাপী ২ লাখ ২৬ হাজারের বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে।
অ্যান্থনি এস ফাউসি এ গবেষণার ইতিবাচক দিক নিয়ে কথা বললেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাইকেল রায়ান সর্বশেষ গবেষণার বিষয়ে বিবেচনা করতে অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণ গবেষণা পর্যালোচনা করেননি। রায়ান বলেন, ‘আমরা সবাই আশায় আছি বর্তমানে নজরদারিতে বা পরীক্ষারত থাকা এক বা একাধিক চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে ফল পাওয়া যাবে এবং মৃত্যু কমাতে সক্ষম হবে।’
গিলিয়াড এনআইএআইডির ফলাফলের আগেই রেমডেসিভিরের উৎপাদন বাড়ানো শুরু করে। মার্চ শেষে সংস্থাটি ৩০ হাজার রোগীর চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করেছিল। এর উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সহজতর করে এবং কাঁচামালের নতুন উৎস সন্ধান করে গিলিয়াড ঘোষণা করেছে, বছরের শেষ নাগাদ ১০ লাখেরও বেশি লোকের চিকিৎসা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রেমডেসিভির তৈরি করবে তারা।
মার্কিন গবেষকেরা পরীক্ষার পরে রোগীদের অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্ভাব্য অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কিংবা অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান সত্ত্বেও স্বাভাবিক ফিরে আসার বৈশ্বিক আশা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিডসের ভাইরোলজিস্ট স্টিফেন গ্রিফিন বলেন, রেমডেসিভির নিয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল, কারণ এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। সবার সন্ধান করা কোনো অলৌকিক ওষুধ এটা নয়। তবে এটি যদি কিছু মানুষকে জটিল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে, তবে তা যথেষ্ট ভালো।