নয়াবার্তা প্রতিবেদক : পার্সেল প্রতারণায় বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দেশি-বিদেশি চক্র।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশী বন্ধু সেজে অভিনব পন্থায় এই চক্রটি বছরের পর বছর তাদের প্রতারণা চালিয়ে আসছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর পল্টনের বাসিন্দা জামিল হোসেন ভূঁঞা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী। ২০২০ সালের ১৬ জুলাই ‘মিথিলা মিথিলা’ নামের ফেসবুক আইডি থেকে তার আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। জামিল ওই রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার পর দুজনের মধ্যে মেসেঞ্জারে কথা হয়। মিথিলা জানায়, সে বর্তমানে ইংল্যান্ডে আছে। তার স্বামী একজন বাংলাদেশি। তিনি (স্বামী) মারা গেছেন। তিনিও (মিথিলা) অসুস্থ। যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর নামে অনেক জমানো টাকা আছে। সেই টাকা জামিলের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাতে চান। টাকা পাঠানো হলে যেন গরিব মানুষের মধ্যে দান করে দেন।
ওই বছরের ৪ আগস্ট বেলা ১২টার দিকে জামিলের মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলা হয়, ‘আপনার নামে ইংল্যান্ড থেকে একটি প্যাকেট এসেছে। ওই প্যাকেটের কাস্টমস চার্জ এসেছে ৭৭ হাজার টাকা।’ পরদিন একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে জামিল ওই চার্জ পরিশোধ করেন। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী ব্যক্তি বলেন, ‘স্ক্যানিং করার পর প্যাকেটে মূল্যবান কিছু সামগ্রী পাওয়া গেছে। তাই স্ক্যানিং খরচ বাবদ আরও ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দিতে হবে।’ সরল বিশ্বাসে জামিল ওই টাকা পরিশোধ করেন। পরদিন আরেকটি মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, ‘আপনার নামে আসা ওই প্যাকেটটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার। সেখানে মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা আছে। তাই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্যাকেটটি নিয়ে ঝামেলা করছে। তাই আরও টাকা লাগবে।’ তখল জামিল যোগাযোগ করেন মিথিলা নামধারী ব্যক্তির সঙ্গে।
মিথিলা জানায়, ‘আমার দেওয়া প্যাকেটে মিলিয়ন টাকার বেশি আছে। এজন্য সরকারি চার্জ আসবে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। আমি চার্জ পাঠাতে ভুলে গেছি। তুমি চার্জ দিয়ে প্যাকেটটি ছাড়িয়ে নাও। পরে প্যাকেট থেকে ওই টাকা তুমি রেখে দিও।’ এরপর জামিল ওই টাকা পরিশোধ করেন। এভাবে ৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা পাঠানোর পর কাস্টম অফিসার, স্ক্যানিং অফিসার ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার অফিসার পরিচয়দানকারী ব্যক্তিরা জামিলকে বলেন, ‘যেসব রসিদের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেছেন, সেগুলো মিথিলা মিথিলা নামের ফেসবুক আইডিতে পাঠিয়ে দেন।’ টাকা পাঠানোর রসিদ পাঠানোর পর তারা বাংলাদেশি ইনকাম ট্যাক্স বাবদ ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। এদিকে জামিলের আগের পাঠানো টাকাগুলো ছিল বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া। আর ধার-কর্জ করার মতো পরিস্থিতিও ছিল না তার। পরে বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারকদের খপ্পরে পড়েছেন। ‘মিথিলা মিথিলা’ আইডি নামধারী প্রতারকচক্রের মূল হোতা হলো লস্কর বিপ্লব। একসময় গোপালগঞ্জে কুলি হিসাবে কাজ করতেন। তার বাবাও ছিলেন কুলি। তিনি ২০০০ সালে ঢাকায় এসে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন। পরে জাড়িয়ে পড়েন অভিনব প্রতারণায়। ১৫ বছর ধরে তিন বিদেশি বন্ধুচক্রের মাধ্যমে প্রতারণা করছেন। কয়েক হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে তার নাম যুক্ত আছে। প্রতিটি অ্যাকাউন্টেই লেনদেন হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে তিনি দুবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। অন্তত শত মামলার মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি বিপ্লব। ঢাকা মাহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পাশাপাশি তাকে খুঁজছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। দীর্ঘদিন পর অবশেষে বিপ্লবসহ কয়েকজন ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা জালে। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে ডিবি। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠেয় সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে বলে ডিবি সূত্র জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদেশি বন্ধুর দামি উপহারের নামে যারা নিয়মিত প্রতারণা করছে, তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত নাইজেরিয়া, কম্বোডিয়া, ক্যামেরুনসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে বিপ্লব লস্করের নেতৃত্বাধীন একটি বাংলাদেশি চক্র জড়িত। প্রতারণার জন্য তাদের রয়েছে বিভিন্ন ডিভিশন। কলিং ও ব্যাংকিং ম্যানেজমেন্ট নামে অভিনব দুটি ডিপার্টমেন্ট খুলে কয়েক ধাপে প্রতারণা করছে চক্রটি। কলিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করে বাংলাদেশি প্রতারকরা। এই বিভাগের লোকেরাই কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে টার্গেট ব্যক্তিকে ফোন করে। এখানে আছে আরও দুটি ভাগ। একটি কার্ড ডিভিশন। আরেকটি চেক ডিভিশন। প্রতারণা করে পাওয়া টাকা জমা হয় বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে। ব্যাংক হিসাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবের হাতে। ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে চক্রের বিদেশি সদস্যদের পৌঁছে দেয় সে। এর বিনিময়ে পায় মোটা অঙ্কের কমিশন।
পার্সেল প্রতারণার শিকার জামিল হোসেন ভূঁঞা বলেন, প্রতারিত হওয়ার পর গত বছরের ২১ জানুয়ারি পল্টন থানায় মামলা করেছি। মামলাটির তদন্ত করছে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিট।
পার্সেল প্রতারণার আরেক শিকার বনানীর হাবিবুর রহমান বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিলে আমার ফেসবুকে জেসিকা ওকার নামের আইডি থেকে একটি রিকোয়েস্ট আসে। রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার পর ওই ব্যক্তি জানান, তিনি আফগানিস্তানে থাকেন। পরে তার সঙ্গে আমার হোয়াটসঅ্যাপেও কথা হয়। একদিন জানায়, তার কাছে এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় আট কোটি ৫০ লাখ) আছে। সেগুলো বাংলাদেশে আমার মাধ্যমে খরচ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আমি সরল বিশ্বাসে রাজি হলে পার্সেল প্রতারণার মাধ্যমে প্রতারকচক্রের সদস্যরা আমার কাছ থেকে ২১ কোটি ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, কয়েক বছর ধরে পার্সেল প্রতারণার যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর সবকটিতেই বিপ্লব লস্করের নাম জড়িত। আমরা তাকে অনেকদিন ধরেই খুঁজছি। মূল হোতাসহ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। আজ (সোমবার) রাতে আরও কয়েকজন ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না। মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে পার্সেল প্রতারণা সংক্রান্ত বিস্তারিত তুলে ধরতে পারব বলে আশা করছি।