বাংলা ট্রিবিউন এর এক প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো, ফজলুল করিম সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নের সোরা গ্রামের আবুল কাশেম সরদারের ছেলে। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বাংলা ট্রিবিউনকে ফজলুল করিম বলেন, “গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নের সোরা গ্রামে আমার বাড়িতে আসি। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ দেয়াল ভাঙার শব্দ হয়। এতে আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। বাইরে এসে দেখি বেশ কয়েকজন লোক হাতুড়ি দিয়ে আমাদের বাড়ির দেয়াল ভাঙচুর করছে। তখন বাড়িতে আমি এবং আমার বাবা-মা ছিলাম। ডাকাত ভেবে চিৎকার করতে থাকি। তখন কেউ এগিয়ে না আসলে শ্যামনগর থানার ওসির কাছে সাহায্য চাই। কিন্তু,তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরে আবারও আমি ওসিকে বলি, স্যার আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। তখন ওসি আমাকে বলেন ‘পুলিশ কি তোর বাপ-দাদার কেনা গোলাম, ডাকা মাত্র তোর বাড়িতে হাজির হবে?’ আবারও অনুনয় করলে তিনি উল্টা বলেন, আগামীকাল সকালে দেখা না করলে আদালতে চালান করে দেবো।’
ফজলুল করিম
তিনি আরও বলেন, ‘এরপর কালীগঞ্জ সার্কেলের এএসপিকে ফোনে বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি ৯৯৯-এ ফোন করে সাহায্য চাইলে শ্যামনগর থানার একজন এএসআই ঘটনাস্থলে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে হামলাকারীরা নগদ দুই লাখ টাকা, ৮০ হাজার টাকা মূল্যের দুটি স্বর্ণের চেন ও ৫০ হাজার টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা বাড়ির সীমানা প্রাচীরও ভেঙে ফেলে। হামলাকারীরা আমাকে এবং আমার বাবা-মাকে মারধর করে পালিয়ে যায়।’
ফজলুল করিমের বাড়ির ভেঙে ফেলা সীমানা প্রাচীর
ফজলুল করিম বলেন, “ঘটনাস্থল থেকে ওসিকে ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলেন এএসআই। ওসি তখন ফোনে আমাকে বলেন ‘ওপর মহলে নালিশ করিস? তোর মামলা হবে না। কোর্টে মামলা কর’। পরদিন এসআই মরিুজ্জামান ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে বলেন, মামলা হবে না। পারলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে মীমাংসা করে নিতে হবে। কিন্তু আমি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারের কাছে সব ঘটনা জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করি।’
ফজলুল করিমের বাড়িতে হামলাকারীদের তছনছ করা আসবাবপত্র
২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সুপার শ্যামনগর থানার ওসিকে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে লিখিত নির্দেশ দেন। কিন্তু,এরপরও ওসি কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় ৩ মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ফজলুল করিম। এরপর ১০ মার্চ প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিষয়টি খোঁজ নিতে মৌখিক নির্দেশ দেন আদালত। পরবর্তীতে মঙ্গলবার (২ এপ্রিল)আবার রিটের শুনানি করতে গিয়ে ঘটনার আংশিক সত্যতা পাওয়ার তথ্য আদালতকে অবহিত করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুল আলম।
পুলিশ সুপারের কাছে ফজলুল করিমের লিখিত অভিযোগ
রিট আবেদনে শুনানির পর মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পুলিশকে মামলা নেওয়ার আদেশ দেন।
এদিকে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের ওসি হাবিল হোসেন বলেন, ‘ফজলুল করিমের বাবা আবুল কাশেম সরদারের অভিযোগে ২ এপ্রিল সকাল ১০টায় এজাহার নামীয় ১০ জনসহ মোট ১৫ জনকে আসামি করে ডাকাতির মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা নং-৩ (তারিখ: ২.৪.১৯)। মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন-ইউসুফ, আয়ুব হোসেন, শমসের, রেজাউল, নাদির সরদার, রফিসহ ১৫ জন। এই আসামির মধ্যে আবুল কাশেম সরদারের একজন আপন ভাই এবং একজন সৎ ভাই রয়েছে।’
ডাকাতি মামলার এজাহারের কপি
এর আগে মামলা না নেওয়ার ব্যাপারে ওসি আরও বলেন, ‘ফজলুল করিমের বাবা আবুল কাশেম সরদারের আপন ভাই ও সৎ ভাইদের সঙ্গে জমি-জমা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে জমি-জমা নিয়ে মারামারি এবং ভাঙচুরের ঘটনায় তিনি শ্যামনগর থানায় অভিযোগ দেন। বলেন, তাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। আমরা তদন্ত সাপেক্ষে মামলা নিতে চেয়েছিলাম। জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে তারা মিথ্যা ডাকাতির মামলা করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তাদের প্রাথমিকভাবে মামলা না নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে মীমাংসা করে নিতে বলা হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই রাতে ফজলুল করিমের সাহেব আমাকে ফোন করা মাত্র আমি এসআই মনিরুজ্জামানকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম। পরেরদিনও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে। কিন্তু বাদীদের যে অভিযোগ ছিল সেটা সত্য ছিল না। সে কারণে মামলা নেওয়া হয়নি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়।’
সর্বশেষ আদালতের নির্দেশে কেন ডাকাতির মামলা রেকর্ড করা হলো সে বিষয়ে ওসি বলেন, ‘ডাকাতির মামলা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এর বেশি তিনি কিছু বলতে চাননি।
উল্লেখ্য, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় মামলা না নেওয়ায় অভিযোগে দায়ের করা রিটের শুনানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ওসি সাহেবরা সব জায়গায় কোর্ট বসিয়ে দেন। ওসি কী সালিশ করতে বসেছেন? তারা সুবিধামতো হলে মামলা নেবেন, অথচ টাকা ছাড়া থানায় একটা জিডিও হয় না।’
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন। শ্যামনগর থানায় মামলা না নেওয়ার প্রসঙ্গে আদালত বলেন,‘ওসি মামলা নিলেন না কেন? আমরা রুল দিয়ে দেখি কেন তিনি মামলা নিলেন না।’ এরপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ওসিরা যেখানে সেখানে কোর্ট বসায়, রাতে কোর্ট বসায়। এতো সাহস তারা কোথায় পায়? তারা নিজেরা বিচার বসায় কীভাবে?’
লিখিত নির্দেশ দেওয়ার পর মামলা না নিয়ে শ্যামনগরের ওসি বিভাগীয় অপরাধ করেছেন বলে জানান সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাজ্জাদুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, ওসি হাবিল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যেহেতু বিষয়টি এখন উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, তাই আদালতের বিষয়টি শেষ হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এসপি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আমি মামলা নেওয়ার জন্য ওসিকে লিখিতভাবেই নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি মামলা নেননি। এরপর ভুক্তোভোগী আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। আদালতের মাধ্যমেই ভুক্তভোগী প্রতিকার পেয়েছেন। এখন আদালতের নির্দেশেই সব হবে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এখন সব হচ্ছে। আদালতের প্রক্রিয়াটি শেষ হলেই ওসির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’