নয়াবার্তা প্রতিবেদক : গত পৌনে তিন বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ২২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের আগেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ৪ সেপ্টেম্বর তা নেমে এসেছে ২ হাজার ৫৬১ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার বা ২৫ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। আর বর্তমানে দেশে বিপিএম-৬ হিসাবানুযায়ী দায়হীন তাৎক্ষনিক ব্যবহারযোগ্য নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ২ হাজার ৫৫ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার বা ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বৃহষ্পতিবার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সর্বশেষ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, পৌনে তিন বছর আগে রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন। গত ৪ সেপ্টম্বর বুধবার দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এটি প্রকৃত রিজার্ভ নয়, এর বাইরে আরও একটি হিসাব হয় যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। সে হিসাবে পৌনে তিন বছরেই রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই হিসাবে প্রকৃত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ বের করতে বিপিএম ম্যানুয়াল থেকে চলতি দায় বাবদ আকু বিল, বৈদেশিক পাওনা, প্রকল্প বকেয়া বিল, এবং বিশেষ পরিপূরক মুদ্রার (এসডিআর) বকেয়া হিসাবে ৫ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। সেই হিসাবে এগুলো বাদ দিয়ে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টদের মতে, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হচ্ছে। তবে তা দিয়ে তেল-গ্যাস আমদানির খরচ মেটাতেই তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রিজার্ভ আর বাড়ছে না। জরুরি এলসি নিষ্পত্তির জন্য বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের সরবরাহ বাড়াতে পদক্ষেপ যে টুকু কার্যকর হচ্ছে তা দৃশমান না। এদিকে, রিজার্ভ কমায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে আমদানিকারকদের মাঝে। কারণ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশের প্রকৃত যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো কষ্টকর। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোন দেশের রিজার্ভ দিয়ে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা থাকা জরুরি। রিজার্ভের এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে আমদানিকারকদের মাঝে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের গড় আমদানি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, ৫ দশমিক ২০ বিলিয়ন এবং ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থ বছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট আট মাসে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ৪৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। যা গড় হিসাবে প্রতি মাসে ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়। আলোচিত সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো কেনা হয়। আরও ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার সোয়াপ পদ্ধতির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বন্ধক রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।
এদিকে, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তিন কিস্তির অর্থ পেয়েছে দেশ। আগামিতে চতুর্থ কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা। অথচ তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের উন্নতি হয়নি। ঋণের শর্ত হিসাবে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অব্যাহতি চেয়েছিল বাংলাদেশ, তা অনুমোদন করেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তি ছাড় করেছিল সংস্থাটি। আইএমএফর শর্ত অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর মার্চ শেষে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ছিলো ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, বাস্তবে তা ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। আবার গত জুনে ২৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তখনও প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফ তাদের ঋণ কর্মসূচির আওতায় গত ২৪ জুন সোমবার তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী দুটি কিস্তি পেতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে বাংলাদেশকে ৩৩টি নতুন শর্ত পূরণের শর্ত দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি হার, নিম্ন রাজস্ব আয় এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব-এই চার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার লক্ষ্যে নতুন শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে দুই ধরনের শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি কর্মদক্ষতার (পারফরম্যান্স) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং বাকিগুলো কাঠামোগত শর্ত। সাতটি শর্তের মধ্যে, বাংলাদেশকে আগামী জুনের মধ্যে নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ (এনআইআর) বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার করতে হবে। এই বছরের জুনের জন্য সংশোধিত লক্ষ্য ছিল ১৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক বাজেট ঘাটতি নির্ধারিত ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, যা ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হলো, চলতি অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি কৃছ্রতা অবলম্বন করতে হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর-রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এর অর্থ, সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে ২১ শতাংশের বেশি। যদিও গত কয়েক বছর ধরে গড়ে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ফলে চলতি অর্থবছরে বাড়তি এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হতে পারে।
