প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে নিষ্পাপ ব্যক্তির কারাভোগ দুর্ভাগ্যজনক : হাইকোর্ট

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে নিষ্পাপ ব্যক্তিকে কারাগারে আটক রাখা দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী। তবে তাঁর বদলে কারাভোগ করছেন মিনু আক্তার। কুলসুম হিসেবে সাজার বিরুদ্ধে মিনুর করা আপিল শুনানিতে আদালত এই মন্তব্য করেছেন। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ রোববার এ শুনানি হয়।

শুনানিকালে আদালত বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এভাবে যদি প্রকৃত অপরাধী অর্থের বিনিময়ে হোক অথবা বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে হোক, নিজেকে বাঁচিয়ে অন্য নিষ্পাপ লোককে জেলের ভেতরে আটক করে রাখে, এটি দুর্ভাগ্যজনক।
আদালতে মিনুর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শিশির মনির ও ইকবাল হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশির উল্লাহ।

শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, তদন্তে চিহ্নিত হয়েছে যে ওই মামলায় মিনু আসামি ও দণ্ডিত নন। মিনুকে দ্রুত মুক্তি দেওয়া উচিত। তাঁর কারাভোগ বেআইনি। প্রকৃত অপরাধী কুলসুমকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাঁকে গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উপযুক্ত আদালতে হাজির করা উচিত। একজনের পরিবর্তে অন্যজন কীভাবে কারাগারে গেল ও কে দায়ী, তা নির্ণয়ে পুরো ঘটনাটির বিচারিক অনুসন্ধান হওয়া দরকার। দেশে গত দুই বছরে ভুল ব্যক্তি শনাক্ত করার মতো ২৬টি ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। একজনের নামে আরেকজন জেলে থাকেন। আসামি বা অপরাধী শনাক্তে বায়োমেট্রিক ও আই বলিং পদ্ধতি বের হয়েছে। যেখানে ভুল হবে না।

এ সময় আসামি বা অপরাধী শনাক্তে ভুল এড়াতে ও সমস্যা সমাধানে বায়োমেট্রিকের মতো পদ্ধতি প্রবর্তনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার আবেদন জানান শিশির মনির।

তখন আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, উল্লেখিত পয়েন্টগুলো লিখিত আকারে আদালতে দাখিল করেন।

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এমন পরিস্থিতিতে বিদেশে ও উন্নত বিশ্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা দেখা যায়। দীর্ঘদিন এভাবে কারাগারে রাখার পর তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। মিনুর স্বামী তাঁকে রেখে চলে গেছেন। এ ধরনের ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার আবেদন জানান তিনি।

শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির উল্লাহ বলেন, ‘আমরাও চাই দেশ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর হোক। অপরাধীর পরিবর্তে নিরীহ ব্যক্তি জেল খাটবেন—রাষ্ট্র এবং বর্তমান সরকার এটি চায় না। শুনানি নিয়ে আদালত আগামীকাল সোমবার শুনানির পরবর্তী দিন রাখেন।’

মিনু যেভাবে কুলসুম ‘বনে গেলেন’ : আদালত সূত্রে জানা গেছে, মুঠোফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কারাগারে পাঠানো হয় কুলসুমকে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ আদালত) আদালত থেকে ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুম।

২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর বিচারিক আদালত ওই মামলার রায় দেন। রায়ে কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুম সেজে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে আসেন মিনু আক্তার। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারিক আদালতের সাজার বিরুদ্ধে কুলসুম হিসেবে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। এই আপিল আজ হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মহিলা ওয়ার্ড পরিদর্শনের সময় কুলসুমের বদলে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এরপর রেজিস্ট্রারের ছায়ালিপিসহ গত ২১ মার্চ চট্টগ্রামের আদালতে একটি আবেদন দেন চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার (চলতি দায়িত্ব) মো. শফিকুল ইসলাম খান। পরদিন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ আদালত) শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালতে মিনুকে হাজির করা হয়।

সেদিনই মিনুর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। মিনুর বক্তব্য অনুযায়ী, মর্জিনা নামের এক নারী তিন বছর আগে ডাল-চাল দেবেন বলে তাঁকে ঘর থেকে নিয়ে এসে জেলে ঢুকিয়ে দেন। তখন তিনি ভাসমান বস্তিঘরে ছিলেন। তাঁর স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। মর্জিনা বলেছিলেন, রোজার পর তাঁকে জেল থেকে বের করবেন। তিনি এখন বের হতে চান। কুলসুমকে তিনি চেনেন না। চট্টগ্রামের আদালত মূল রেজিস্ট্রারটি আদালতে দাখিল করতে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপারকে নির্দেশ দেন। রেজিস্ট্রারে থাকা আসামি কুলসুম আক্তারের ছবির (২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর) সঙ্গে মিনুর ছবির অমিল পাওয়া যায়। এরপর গত ২৩ মার্চ চট্টগ্রামের আদালত জরুরি ভিত্তিতে ওই উপনথি হাইকোর্টে পাঠাতে আদেশ দেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ আদালত) বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞার পাঠানো চিঠিসহ ওই মামলাসংশ্লিষ্ট উপনথি গত ২৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছায়।

Share